For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক, দুবাই টাকা পাচার

টি রিসোর্টের চাকরিতে পাল্টে যায় শামসুদ্দোহার ভাগ্য!

Published : Tuesday, 3 September, 2024 at 1:19 PM Count : 1418

মৌলভীবাজারেশ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ টি বোর্ডের আওতাধীন টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের ম্যানেজার মো. শামসুদ্দোহা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আখড়ার মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে রাতারাতি গাড়ি, বাড়িসহ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

দীর্ঘ এক মাসের অনুসন্ধানে টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের ভেতর চলমান এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। রিসোর্টের কোনো কর্মচারি দুর্নীতির বিষয়ে মুখ খুলতে চাইলেই সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের আপন ভাই বলে ভয় দেখাতেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের (১১, ১২ ও ১৩ তারিখ) তিন রাত্রি টি রিসোর্টে অবস্থান করেন। তিনি তিন দিনের খাবার বিল বাবদ ৩ লাখ ২৬ হাজার ৩১ টাকা এবং বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ ১৪ হাজার ৭০০ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু অফিসের ফাইনাল বিলে শামসুদ্দোহা খাবার বিল বাবদ ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৩ টাকা এবং গাড়ি ভাড়া বাবদ ৯ হাজার ৬৬১ টাকা জমা করেন। খাবার ও গাড়ি ভাড়ার ব্যবধানকৃত ২৯ হাজার ৭৮৭ টাকা তিনি তার পকেটে ভরেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামে মুকুল, এসআইবিএল নামে কয়েকটি বাংলো বুকিং ছিল। তাদের খাবার ও অন্যান্য বিলের জন্য তারা ৭৮ হাজার ৯১৬ টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু অফিসের ফাইনাল বিলে শামসুদ্দোহা ৭৪ হাজার ৫৯৬ টাকা জমা করেন। অবশিষ্ট ৪ হাজার ৩২০ টাকা তিনি তার পকেটে নিয়ে নেন। চলতি বছরের ২৪ আগস্ট আকিব খান নামে একজন গেস্ট আসেন। তিনি ভোর ৫টার দিকে আসায়, অর্ধেক বেলার চার্জ (অর্থ) নেন ম্যানেজার। সেই অর্ধেক বেলার চার্জের ৪ হাজার ৮৩০ টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ম্যানেজার মো. শামসুদ্দোহা অফিসের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট নাম্বার থাকা সত্বেও অফিসে গেস্টদের সাথে কথোপকথনের জন্য ব্যবহৃত নাম্বারে (০১৭১২০৭১৫০২) লেনদেন করেছেন। 

শামসুদ্দোহা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের ভাই। তবে, শোভনের বিষয়ে অস্বীকার করে তিনি বলেন, শোভন তার আপন ভাই নয়, এলাকার ছোট ভাই।

২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট গৌরাঙ্গ রায় রিসোর্টের বাংলোতে অবস্থান করেন। তিনি এবং তার বন্ধুবান্ধব মিলে ঘরোয়া পরিবেশে বিনোদনের আয়োজন করলে রিসোর্ট ম্যানেজার শামসুদ্দোহা তাদের থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। ওই অর্থ তিনি (শামসুদ্দোহা) অফিসে জমা না করে নিজের পকেটে ভরেন।

এদিকে, রিসোর্টটির ম্যানেজার পদ শূন্য থাকায়, ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর বণিক বার্তা পত্রিকায় শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিগ্রি পাশ (বিএ) চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এইচএসসি পাশ শিক্ষাগত যোগ্যতায় রিসোর্টের ম্যানেজার পদে নিয়োগ পান মো. শামসুদ্দোহা। যেখানে প্রতিদিন দেশের স্বনামধন্য ভিআইপি অতিথিরা, সরকারি, বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ এসে থাকেন। সেখানে কিভাবে এত অল্প শিক্ষিত এ রকম অযোগ্য লোক নিয়োগ পায়। তা নিয়ে জনমনে উঠেছে প্রশ্ন। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের সুনাম, ব্যবসায়িক ক্ষতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা প্রশ্ন তুলেছেন।

ওই রিসোর্টের একাধিক কর্মচারি সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ০৬ মে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ৬০ জন কর্মকর্তা টি রিসোর্টে দুপুরের খাবার সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভোক্তা অধিদপ্তরের অফিস খাবার বিল পরিশোধ করলেও সেই অর্থ টি রিসোর্ট খাতে জমা হয়নি। যা শামসুদ্দোহা আত্মসাৎ করেন। তাছাড়া অনেক বুকিং অগ্রিম মানি বুকিং বাতিল হওয়ার পর নিয়মমতো তা ফেরত না দিয়ে তিনি নিজে আত্মসাৎ করেন।’

সূত্র জানায়, টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের ম্যানেজার শামসুদ্দোহা বিগত ছয় বছর যাবৎ চাকুরি করে অনেক অর্থ অবৈধ ভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে টয়োটা ফানকার্গো ঢাকা মেট্রো -খ ১২-১৫২৬ সিরিয়ালের একটি প্রাইভেটকার ক্রয় করেন। গত বছর (২০২৩) সালে তার স্ত্রী ও মেয়েকে ৩ মাসের জন্য দুবাই ট্যুরিস্ট ভিসায় বেড়াতে পাঠান এবং দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা দুবাই পাঠিয়েছেন। তাছাড়া ২০২৩ সালে রংপুরে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি ক্রয় করেন।

এদিকে টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারি ও বিভিন্ন ব্যক্তি জানান, ‘রিসোর্টে তার এলাকার নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারিদের খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় বৈধ অবৈধ সব সুযোগ সুবিধা নিয়মিত দিচ্ছেন। কিন্তু অন্যদের প্রতি তিনি খুবই দুর্ব্যবহার করে থাকেন। তিনি (শামসুদ্দোহা) বলে বেড়ান, চা বোর্ড চেয়ারম্যান আমার এলাকার। তাছাড়া চেয়ারম্যান ও টি রিসোর্টের সিইও এর ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি রিসোর্টে আগত অতিথিদের সাথে এবং অন্য সব কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে থাকেন। চেয়ারম্যানের দাপট দেখিয়ে সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। শামসুদ্দোহার অত্যাচারে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ থেকে ১০ জন কর্মচারি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।’

রিসোর্টটিতে থাকা একাধিক কর্মচারি বলেন, ‘ম্যানেজারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার হাজিরা কেটে দেয়। গেট বন্ধ করে দেয়, কাজে আসতে দেয় না। ছুটি মঞ্জুর করে ছুটি কাটালেও বেতন কর্তন করে দেয়। কিন্তু তার এলাকার কর্মচারিদের এবং অন্যান্য কর্মচারি যারা রয়েছেন, তাদের বেতন কর্তন করা হয়না। একদিন যদি অসুস্থ থেকে  ছুটি কাটাই তাহলে তিন দিনের বেতন কেটে নেয়।’

চাকরিচ্যুত হওয়া টি রিসোর্টের সাবেক হেড কুক মো. কামাল হোসেন ডেইলি অবজারভারকে বলেন, ‘সেই দিন ছিলো ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। হঠাৎ টি রিসোর্টের ম্যানেজার মো. শামসুদ্দোহার সাথে একটু তর্কবিতর্ক হয়। ২০ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত আমার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি কাজ করেছি, তবু আমার বেতন দেওয়া হয়নি। ২৬ তারিখে পুনরায় কাজে যোগদান করি। ওইদিন থেকে ১৫০ জনের একটা টিম (গেস্ট) ০৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলো রিসোর্টে। ০১ নভেম্বর থেকে পুনরায় আমার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন মো. শামসুদ্দোহাকে জিজ্ঞেসা করি কেন আমি কাজ করতে পারব না? তখন তিনি বলেন রিসোর্টে আপনাকে প্রয়োজন নেই। তারপরও আমি কাজ করি।’

তিনি বলেন, ‘রিসোর্টের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিতে গেলে হাজিরা খাতা তার অফিসে রেখে দেওয়া হয়। আমি স্বাক্ষর দিতে পারিনি। তখন আবার তাকে বলি- আমার কাজ বন্ধ করে আবার পুনরায় কাজে নেওয়া হলো কেন? তখন তিনি বলেন- আমার প্রয়োজন ছিলো নিছি, এখন প্রয়োজন নেই আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আমি যে কাজ করেছি, তার প্রমাণ আমার কাছে আছে।’

কামাল হোসেন বলেন, ‘আমাকে বেতনও দেওয়া হয়নি। তার উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে বের করে দেওয়া। তার কারণ হলো আমি তাদের বিষয়ে সবকিছু জানতাম, তাদের অনিয়মের বিষয়। তারা যে কি পরিমাণ লুটপাট করেছে এই রিসোর্ট থেকে। আর এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে বের করার। আমি নিরীহ, তাই কোনো প্রতিবাদ করিনি। তারপরও শামসুদ্দোহারকে অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু তিনি আমার কোনো কথা শোনেননি। আমি যে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি, তার একটা অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট চেয়েছিলাম। কিন্তু তাও আমাকে দেওয়া হয়নি। আমার বাসায় গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়। বিনা অপরাধে আমাকে চাকরিচ্যুত করেছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

এদিকে, হুন্ডির মাধ্যমে দুবাই টাকা পাঠানোর বিষয়ে সত্যতা যাচাই করতে কথা হয় যিনি টাকা পাঠিয়েছেন তার সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘২০২৩ সালে তার মাধ্যমেই ৮ লাখ টাকা দুবাই পাঠিয়েছেন টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের ম্যানেজার মো. শামসুদ্দোহা।’

এসব অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চেয়ে শামসুদ্দোহার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অনিয়ম অস্বীকার করে ডেইলি অবজারভারকে বলেন, ‘তিনি ২০১৮ সালে নিয়োগ পান এবং তিনি ডিগ্রি পাস। ১২ লাখ টাকায় বাড়ির জায়গা বিক্রি করে ৮ লাখ টাকায় গাড়ি কিনেছেন। দুবাইতে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় দেড়-দুই লাখ টাকার মতো পাঠিয়েছি। অবৈধ পথে কোনো টাকা পাঠাননি।’

পরিবারের দুবাই ট্যুরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কের আত্মীয় দুবাই থাকেন, তিনি স্পন্সর করে নিয়ে গেছে আমার পরিবারকে। তাছাড়া টি রিসোর্টে আসা গেস্টদের বিলের হিসাবের সকল ডকুমেন্টস অফিসে রয়েছে।’

তিন দিনের গেস্ট থাকার খরচের বিষয়ে একটি হিসাব চাইলে তিনি অফিসে ডাইরেক্টরের সাথে কথা বলার জন্য বলেন।

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,