For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে চোরাই গরু

Published : Saturday, 28 September, 2024 at 6:51 PM Count : 348

রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। চাঁদের আলোয় কিছুটা আলোকিত ঘন জঙ্গলে ভরা জনপথ। সেই আলো-আঁধারির খেলায় কিছু মানুষের চোখে ঘুম নেই। মানুষ যখন গভীর ঘুমে, তখন তারা ব্যস্ত সীমান্তে। সীমান্ত পেড়িয়ে এপারে আসবে গরুর পাল। নির্ঘুম মানুষগুলোর অপেক্ষা সেই গরুর পালের জন্য। 

রাত যত গভীর হয়, ততই বাড়ে গরুর ঢল। সীমান্তের পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে একটু এগুলেই অপেক্ষায় আছে ট্রাকের বহর। সেই ট্রাকে দলে দলে সওয়ার হচ্ছে একের পর এক গরু। তারপর রাতেই আঁধারেই সেই ট্রাক চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। এভাবেই কাঁটাতারের ঘেরা, খরস্রোতা নদী আর পাহাড় পাড়ি দিয়ে ওপার থেকে আসা গরু মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশের হাট-বাজারে। যার নাম ‘বার্মাইয়া গরু’। 

কক্সবাজারের কাছের সীমান্ত উপজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কালাচাইন্দা এলাকায় এটাই নিত্যরাতের দৃশ্য। এই কাজে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সন্ত্রাসী ও প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তি জড়িত থাকায় চোরাচালানের এই চক্রটি বেশ শক্তপোক্ত, অপ্রতিরোধ্য। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের ওপারের গরু এপারে আনতে চোরাকারবারিদের তাই ঘাটে ঘাটে দিতে হয় বখরা। সেই বখরা দিয়ে সীমান্ত পথে এই চোরাচালান হয়ে উঠে অত্যন্ত সরল ও মসৃণ। বিপরীতে সীমান্ত রক্ষীদের চোখ এড়াতে চলে নানা কিসিমের কেরামতি। শুধু বান্দরবান কিংবা কক্সবাজার সীমান্ত নয়, দেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এভাবেই চোরাই গরু আনছে একাধিক বড় চক্র। এতে সরকার হারাচ্ছে বড় আকারের রাজস্ব। 

এদিকে, মিয়ানমার ও ভারত থেকে গরু আসবে না- সরকারের এমন ঘোষণায় দেশি খামারিদের বুকে আশা জাগলেও সীমান্ত দিয়ে দেদারছে গরু ঢোকায় তাদের সেই আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। তারা এখন লোকশানের শঙ্কায় পড়েছেন।
যদিও প্রশাসনের দাবি, মিয়ানমার থেকে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, গরু পাচারের কারণে সীমান্ত এলাকার খামারের পশুর শরীরে নানা ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। 

খামারিদের অভিযোগ, দেশে বৈধ পথে আনা পশুর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয। অথচ চোরাই পথে আসা গরুর শরীরে রোগ আছে কি না, তা জানারও সুযোগ নেই। এতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা।

২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে বৈধ পথে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বাড়ানো হয় গবাদি পশু পালন। দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ লাখ খামার আছে। ভারত ও মিয়ানমারের কড়াকড়ির কারণে কয়েক বছর ধরে সীমান্ত পথে তেমন গরু আসেনি। কিন্তু ইদানিং সীমান্ত পথ অনেকটাই ঢিলেঢালা।

সূত্র মতে, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও চকরিয়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির অন্তত ১০/২০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে সবচেয়ে বেশি গবাদি পশু ঢুকছে। স্থানীয়দের এমনটাই অভিযোগ। 

স্থানীয়রা বলছেন, গরু চোরাচালানের ক্ষেত্রে সীমান্ত পার করার জন্য দুই ধরনের লোককে কাজে নামায় চোরাকারবারী চক্র। একটি গ্রুপ গরুর সঙ্গেই থাকে; আরেকটি গ্রুপ রাস্তায় পুলিশ, বিজিবি থাকে কি না, তা জেনে কারবারীকে খবর দেয়। তারা গরুপ্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা করে পায়। সীমান্ত পার হওয়ার পর দেশের কোনো হাট থেকে টাকার বিনিময়ে গরু কেনার নকল কাগজপত্রও তৈরি করে নেওয়া হয়। এতে পথে আর পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয় না। রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হওয়া গরু নির্বিঘ্নেই দিনের আলোতে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে পৌঁছে যায়।

সীমান্তের ১৪ পয়েন্ট
কক্সবাজার ও বান্দরবানের ১৪টি পয়েন্ট ব্যবহার করে গরু চোরাচালান করে কারবারীরা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী ও জামছড়ি এবং কক্সবাজারের রামু উপজেলার হাজিরপাড়া, বালুবাসা, ডাক্তারকাটা ও মৌলভীরকাটা দিয়ে চোরাই পথে মিয়ানমারের গরু আসছে। 

সীমান্ত এলাকার লোকজনদের মতে, চিহ্নিত ১০/২০ ব্যক্তির নেতৃত্বে দুই শতাধিক চোরাকারবারী এসব এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারাই রাতের আঁধারে মিয়ানমারের গরু সীমান্ত পার করে ঢাকাসহ দেশের নানা হাট-বাজারে পৌঁছে দিচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, ডাকাত ও ব্যবসায়ী এই চোরাচালানে সরাসরি জড়িত। তাদের মধ্যে রয়েছেন- রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু মো. ইসমাঈল নোমান, এমইউপি শাহজাহান সিরাজ শাকিল, ৭ নং এমইউপি মো. জসীম উদ্দীন, ৪ নং এমইউপি জসিম উদ্দীন, যুবলীগ নেতা জসিম, রামু উপজেলার আন্তঃজেলা ডাকাত সর্দার শাহিনুর রহমান শাহিন, কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাছির উদ্দিন সোহেল সিকদার, গর্জনিয়া বাজার সমিতির সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, গর্জনিয়া ফইয়জুল উলুম ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসার শিক্ষক মওলানা ছালামত উল্লাহ, কচ্ছপিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক মাষ্টার কবির আহম্মদ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মো. বদু, ইয়াছিন আরাফাত রিশাদ, যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, যুবদল নেতা মো. আলী, রামু উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, কচ্ছপিয়া ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মো. শওকত, নজরুল, রামু যুবলীল নেতা শাকিল আদনান ও ছাত্রলীগের কক্সবাজার জেলা সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসেনের বড় ভাই রামু যুবলীগ নেতা মো. শুক্কুর কোম্পানী, ছাত্রলীগ নেতা তারেক উদ্দিন মিশুক।

তাদের মতে, এরা ছাড়াও তাদের সহযোগী হয়ে আরও অনেক মানুষ এই চোরাচালানে জড়িত।

অপরদিকে, মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা গরু নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চাকঢালা বাজার, রামুর গর্জনিয়া বাজার ও ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাহ বাজারের রশিদের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। এই তিন বাজারে রশিদ নিয়েই ট্রাক ভর্তি করে মহাসড়ক দিয়েই অবৈধ গরু বৈধপন্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে। 

অভিযোগ রয়েছে, এই পাচারের সঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমনও জড়িত রয়েছেন।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত হাটগুলোতে তোলা বেশির ভাগ পশুই মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের। 

তার মতে, মিয়ানমার থেকে আসা গরু কিছুটা রোগা। তাই ওই সব গরুর দাম কম হওয়ায় চাহিদাও কিছুটা বেশি। এতে দেশি খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

শনিবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসমাত জাহান ইতুর মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

-এফআই/এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,