Friday | 6 December 2024 | Reg No- 06
হোম

ছাই থেকে পিতলের তৈজসপত্র

Published : Sunday, 22 September, 2024 at 1:08 PM Count : 305

পিতল হলো তামা ও দস্তার সংকর। পিতলের বিবিধ ব্যবহারের মধ্যে প্লেট, গ্লাস ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরী করা যায়। পিতলে যথেষ্ট পরিমাণে দস্তার উপস্থিতি বিদ্যমান। দস্তা প্রদাহ কমাতে, দ্রুত ক্ষত নিরাময়, কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি নিরবচ্ছিন্ন বিপাকের ক্ষেত্রেও সহায়ক। তাই শরীরে দস্তার ঘাটতি থাকলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পাশাপাশি পিতলের তৈজসপত্রে রান্না করা বা খাবার খাওয়া শুরু করা যেতে পারে।

সাভারেআশুলিয়া উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের কাছৈর গ্রামের ৯৫ শতাংশ পরিবারের প্রধান কাজ ছাই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ। সেখানে গিয়ে দেখা যায় কিভাবে ছাই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করা হয়।

কাছৈর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে তৈয়ব আলী (৫৫)। ছাই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করেন তিনি। জানালেন কিভাবে তৈরি করা হয় পিতলের তৈজসপত্র।

ডেইলি অবজারভারকে তিনি বলেন, 'ছাই ক্রয় করা হয় ঢাকার মুরগীটালা, জুরাইন, পোস্তাগোলা, মীর হাজীরিবাগ ও যাত্রাবাড়ীর মৃধাবাড়ী থেকে। ছাইগুলা তারা সংগ্রহ করেন স্টীল ও রড তৈরি কারখানা থেকে। ৫০ কেজি ওজনের বস্তা ১ হাজার ৫০০ টাকায় ক্রয় করেন। ছাইয়ের বস্তা কাছৈর এলাকার তার নিজ বাড়িতে এনে স্টীলের বড় পাত্রে ঢালেন। তারপর পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানিতে ধৌত করেন। পানিতে ধোয়ার ফলে উছিস্ট অংশ পানিতে ভেসে যায়। পাত্রের তলানীতে পড়ে থাকে পিতলের গুঁড়ি। এভাবে এক বস্তা ছাই পানিতে ধোয়ার ফলে ১৫ কেজি পিতলের গুঁড়ি সংগ্রহ করা যায়। একজন লেবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৫-৭ বস্তা ছাই ধুয়ে মজুরি পায় ৩০০ টাকা।'
তিনি আরও বলেন, 'এরপর গুঁড়ি রোদে শুকিয়ে মহিলারা ঢেঁকিতে পারান। প্রতিটি ঢেঁকিতে ৩-৪ জন মহিলা শ্রম দেন। তাদের প্রতিজনকে মজুরি দেয়া হয় ১০০ টাকা। ঢেঁকিতে পিতলের শুকনো গুঁড়ি পিসানোর পর আবারও পানিতে ধোয়া হয়। পূর্বের ন্যায় পানি ছেকে রৌদে শুকানো হয়। এরপর আবারও ঢেঁকিতে পারানোর পর পিতলের গুঁড়ি মাটি ও তুস দিয় তৈরি ঠুলিতে ঢুকানো হয়।'

তৈয়ব আলী বলেন, 'তবে ডিজিটাল ঢেঁকি ব্যবহারে এখন কিছুটা লেবার খরচ কমে গেছে। এক একটি ঠুলিতে ১০/১২ কেজি গুঁড়ি ধরে। গুঁড়ি ভর্তি ঠুলি তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি চুলায় দেয়া হয়। একটি চুলায় সাতটি ঠুলি দিয়ে কয়লার আগুনে তাপ দেয়া হয়। ঠুলি পুরো লাল টগবগে হলে চুলা থেকে উঠিয়ে উছিস্ট অংশ উপর থেকে ফেলে দিয়ে ১ ফুট দৈর্ঘ্যের আড়াই থেকে ৩ ইঞ্চি চওড়া সাজের ভিতর তরল পিতল ঢালা হয়। কিছুক্ষণের মধ্য তরল পিতল শক্ত হলে সেটি ঠান্ডা করে সাজ থেকে বের করা হয়। এটিকে বলা হয় পিতলের বাট।'

তিনি বলেন, 'একটি ঠুলি থেকে দুটি বাট তৈরি হয়। যার প্রতিটির ওজন ৫ কেজি। এ বাটগুলো মহাজনদের নিকট বিক্রি করা হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে। মহাজনরা শ্রমিকদের সপ্তাহে ১০/১৫ হাজার টাকা দাদন দেন। ফলে শ্রমিকরা তাদের বাট অন্যত্র বেশি দামে বিক্রি করত পারেন না। মহাজনের যাতাকলে তারা বন্দি। মহাজন যে মূল্য নির্ধারণ করবেন। সেটাই তাদের মেনে নিতে হয়।'

ছাই ধোয়ার কারিগর রিপন ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমরা মহাজনের নিকট থেকে অগ্রীম টাকা নিয়ে থাকি। সেই অগ্রীম টাকা বাবদ কত মাস, কত বছর এই মহোজনের অধীনে কাজ করতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়।'

ঢেঁকি দিয়ে পিসানোর পর মাল তৈরির কারিগর আনোয়ারা বলেন, 'আমরা তো আগে ৪/৫ জন মিলে ঢেঁকি পারাতাম। এখন ডিজিটাল ঢেঁকি হওয়ার পর আমাদের ঢেঁকি পারাতে হয় না। গুড়া মালটি ছেকে ধোঁয়ার জন্য প্রস্তুত করে দেয়।'

ঠুলি বানানোর কারিগর নুর হোসেনের মা বলেন, 'আমাদের কাজ শুধু ঠুলি বানানোর, ঠুলি বানিয়ে শুকিয়ে মহাজনের কাছে পিস হিসাবে বিক্রী করা হয়। প্রতি পিস ১০০ টাকা।'

বাট বানানোর কারিগর জব্বর বলেন, 'আমরা গুড়া মালটিকে প্রস্তুত করে আগুনে তাপ দিয়ে মহাজনের চাহিদা অনুযায়ী পিতলের ও দস্তার বাট তৈরি করি।'

মহাজন জিয়া রহমান ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বাপ-দাদার পুরাতন ব্যবসা আমাদের। এখন সব কিছুর দাম বেশি তাই আগের মতো লাভ হয় না, কাঁচামাল কিনতেও বেশ বেগ পোহাতে হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মাল জোগাড় করা বেশ কষ্টকর।'

আরেক মহাজন জোহর ইসলাম বলেন, 'আমার বাজারের দোকানে কাসা পিতলের সকল তৈজসপত্র বিক্রি হয়। এই যেমন- কাসার বেলি, গ্লাস, বাটি, কলসি, ঘন্টা, ড্যাগসহ অনেক কিছু। আগের দিনে কাসার বেশ প্রচলন ছিল, এখন নাই বললেই চলে। আগের মতো বিক্রি নেই, তাই মাল কম বানানো হয়।'

কাছৈর গ্রামের সর্বপ্রথম যিনি এই ব্যবসা এলাকায় নিয়ে আসেন তার নাম হাজী হানিফ আলী। তার ছোট ছেলে আতাউর রহমান ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমরা জন্ম গ্রহণের পর থেকে আমার বাপ-চাচাদের এই ব্যবসা দেখে আসছি। এখনো চলমান রয়েছে। ঢাকাসহ চট্টগ্রামে আমাদের বড় আকারে ব্যবসা রয়েছে। আমার বাবার দেখাদেখি এলাকায় ঘরে ঘরে এখন এই মেটাল ব্যবসা।'

পাইকারী ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, 'ঢাকার মিটফোর্ড ও রজনী বোসলেন আমাদের দোকান। এখান থেকে আমরা দেশের বাইরে সহ সারা বাংলাদেশে সরবরাহ করি।'

ওই এলাকার কামার মজিন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'মহাজনরা পিতলের বাট ও জ্বালানি হিসাবে কয়লা সাপ্লাই দেন। তাদের অর্ডার অনুযায়ী তৈরি করেন বিদ্যালয়ের ঘন্টা, বেলি ও কাসা। এতে মুজুরি হিসাবে প্রতি কেজিতে দেয়া হয় ৮৪ টাকা।

কাছৈর গ্রামের ৭/৮ হাজার নারী-পুরুষ মেটাল ব্যবসা নামে পরিচিত এ শ্রমের সাথে জড়িত। যার যার বাড়ির আঙ্গিনায় এভাবে পানিতে ছাই ধৌত করে পর্যায়ক্রমে পিতলের গুঁড়ি বের করা হয়। প্রায় ২০০ বছর যাবৎ তাদের পূর্ব পুরুষরা এ পেশার সাথে জড়িত ছিল। তারাও এ পেশায় রয়েছেন। তবে এ শিল্পের পেশায় নিয়োজিতরা দিন দিন পেশা বদল করছেন। 

কারণ হিসেবে জানা যায়- কাঁচামালের মূল্য বদ্ধি, পরিবহন খরচ তিন গুন বেশি, কাঁচামাল আনতে পথে পথে পুলিশের হয়রানী ও চাঁদা প্রদান। চারদিকে নদীবেষ্টিত বংশাইয়ের শিমুলিয়ার কাছৈর গ্রাম। বর্ষাকালে চারদিকে অথৈ পানি থাকে। সে সময় ঘর থেকে বের হওয়া কষ্টকর। রাজধানীর নিকটবর্তী হওয়া সত্বেও এলাকার যাতায়াত ও জীবনধারণ অতি সাধারণ। 

স্থানীয় ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা থাকলে   পিতলের বাট ও তৈজসপত্র বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। মেটাল ব্যবসার সাথে জড়িত শ্রমিকদেরও জীবনমান উন্নত হবে।'

এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000.
Phone: PABX- 41053001-06; Online: 41053014; Advertisement: 41053012.
E-mail: [email protected], news©dailyobserverbd.com, advertisement©dailyobserverbd.com, For Online Edition: mailobserverbd©gmail.com
🔝
close