বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন ভোলার চরফ্যাশনের উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার জেলে। কিন্তু জেলেদের জন্য নেই কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম। ফলে সমুদ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছরই বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা কিংবা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে অধিক লোভের আশায় জেলেদেরকে সাগরে পাঠান ট্রলার ও আড়ত মালিকরা। মালিকের লোভের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঘটনার কবলে পড়লে নিখোঁজ বা মৃত জেলের লাশ উদ্ধারে সহযোগিতায় মালিকদের পাশে পাওয়া যায় না।
চলতি বছর সাগরের মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার উপেক্ষা করে মাছ ধরতে গিয়ে গত ২৫ জুন ১৩ মাঝি-মালাসহ চরফ্যাশনের সামরাজ ঘাটের জাহাঙ্গীর মাঝির ট্রলার ডুবে যায়। এরপর গাফিলতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। ঘটনার পর
জাহাঙ্গীর মাঝি ও তার ছেলে আব্দুল গনিকে জেলেরা জীবিত উদ্ধার করেন।
২৮ জুন জাকির, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার ও জাকির-২ নামের আরও চার জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় সাগর থেকে। ঘটনার ছয় দিন পর সাগরের তিন চর এলাকা থেকে নিখোঁজ শরীফ, মোহাম্মদ হারুন, আব্দুস সাত্তার হালাদার, ফজলে করিম, নুর ইসলাম, মো. শিহাব ও রহিম মাঝি লাশ উদ্ধার করেন স্বজনরা। তাদের বাড়ি চরফ্যাশনে।
পরিবারের অভিযোগ, ট্রলার ও আড়ত মালিকদের অসহযোগিতায় প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও ট্রলারের অভাবে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার তাৎপরতা চালানো সম্ভব হয়নি।
নিহত নুর ইসলামের ভাই মো. রফিকের অভিযোগ, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আড়ত মালিক জয়নাল মিয়া ট্রলার দিয়ে সহযোগিতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত করেননি। সেই সময় উদ্ধার অভিযান চালানো হলে সবাইকে জীবিত পাওয়া যেত।
নিহত শিহাবের চাচা সিরাজ বলেন, আড়তদার জ্বালানি তেল দেওয়ার কথা বলে দুই দিন ঘুরিয়েছে। পরে বিভিন্ন জেলে ও ট্রলার থেকে তেল তুলে সাহায্য নিয়ে তারা সাগরে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে পাঁচ দিন পর পাঁচ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন রহিম মাঝে ছেলে মিলন।
২০২২ সালের অক্টোবরে মা ইলিশ মাছ রক্ষার অভিযানে মধ্যেই ভোলার শতাধিক ট্রলার সাগরে পাঠায় মালিকপক্ষ। ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে সাতটি ট্রলার ডুবে যায়। এর মধ্যে নুসরাত ট্রলারের ২০ জন, শারমিন ট্রলারের
আট জন, এফবি তিন্নি ট্রলারের ছয় জন, এফবি আম্মাজানের ১১ জনসহ ৭৮ জন জেলে নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে ভারতের কারাগার থেকে দুই দফায় ৩৬ জন জেলে উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৪২ জন। নিখোঁজদের বাড়ি চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায়।
সিত্রাংয়ে চরফ্যাশনের মায়া ব্রিজ এলাকার মনির মাঝির ট্রলারটি ২২ মাঝি-মাল্লা নিয়ে ডুবে যায়। এর মধ্যে কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ১০ মাস অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাদের জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনরা।
নিখোঁজ মনির মাঝির স্ত্রী নুসরাত বেগম বলেন, মালিকপক্ষ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সাগরে মাছ ধরার নামে তাদের মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য হুমকি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার বা মালিক পক্ষ নিখোঁজদের সন্ধানে তৎপরতা চালায়নি। দুর্ঘটনার পর থেকে এসব পরিবারের সদস্যরা অভাবের মধ্যে থাকলেও তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি।
মনির মাঝির ট্রলারে ছিলেন চরফ্যাশন চর কর্মী ইউনিয়নের নাংলা পাতা গ্রামের তৈয়ব, কবীর ও আবুল কাশেম। তারা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তাদের অনুপস্থিতিতে পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুদর্শা।
আবুল কাশেমের ভাই মিজান অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষের লোভের কারণে তারা এখন নিঃস্ব। সাগরে গিয়ে প্রাণ গেলে বিচার বা সাহায্য কিছুই পাই না।
একই এলাকার ট্রলারের মাঝি নুরুল ইসলাম সিত্রাং এর কবল থেকে বেঁচে ফিরেছেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে ট্রলার সাগরে পাঠানো হয়েছে। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেয়ার কারণে ঝুঁকির মধ্যে সাগরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি চরফ্যাশন উপজেলার সভাপতি মো. সোহাগ বলেন, মালিকপক্ষের লোভের কারণে সাগরে জেলেদের সলিল সমাধির ঘটনা বেড়েই চলেছে। সাগরে ডুবে নিখোঁজ জেলে পরিবারের দুদর্শা লাঘবে সরকার ও মালিকদের কেউই এগিয়ে আসে না।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. মারুফ মিনার বলেন, জেলেদের উদ্ধারে সাগরে যাওয়ার মতো যানবাহন নেই আমাদের।
তারপরও জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করা হবে।
-এমএ