অভিযান-১০ লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডের ১ বছর
প্রিয়জন হারিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে পরিবারগুলোর
Published : Friday, 23 December, 2022 at 10:08 PM Count : 256
গত ২৩ ডিসেম্বর ২৮ দিনের সদ্যোজাত পুত্রসন্তান সিফাতুল্লাকে দেখতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে চড়েন রিয়াজ হাওলাদার। ওই দিন লঞ্চটি ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীতে পৌঁছালে ভোর রাত ৩টার দিকে লঞ্চটিতে আগুন লেগে যায়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যারা মারা যান তাঁদের মধ্যে ছিলেন বরগুনার বেতাগীর রিয়াজও। প্রিয় স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে মুক্তা বেগমকে।
সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ ট্র্যাজেডির এক বছর পর শুক্রবার নিহত রিয়াজের গ্রামের বাড়িতে যায় এ প্রতিবেদক। বাড়িতে গিয়ে রিয়াজের কথা মনে করিয়ে দিতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগম। শোকার্ত স্ত্রীকে এ সময় সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন প্রতিবেশীরা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুক্তা বলেন, ২৮ দিনের ছেলের মুখ দেখতে সেদিন বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন রিয়াজ। কিন্তু ছেলের মুখ আর দেখতে পারেননি। সেই ছেলের বয়স এখন ১ বছর ২৮ দিন। শুধু ভিডিও কলেই ছেলের মুখ দেখেছিল রিয়াজ। বড় ছেলের নামের সাথে মিল রেখে সিফাতুল্লাহ নামটাও তিনি রেখেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। দুই ছেলে আর শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে অনেক অভাব অনটনে সংসার চলছে। সরকারি বেসরকারি যেটুকু সহায়তা পেয়েছি তা দিয়ে কোনোমতে একটি বছর চলেছি। আমার শ্বশুর জমি চাষ করে যেটুকু উপার্জন করে এখন তাতেই সংসার চালাতে হয়। ছেলেদের মুখে দুবেলা ভালো খাবার তুলে দিতে পারি না। ওদের কীভাবে মানুষ করব এখন সেই চিন্তাই করি এখন।’
রিয়াজের বাবা-মা ছেলে হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না। ছেলের কথা বলতেই কাঁদতে কাঁদতে বারবার মুর্ছা যান মা পিয়ারা বেগম। বৃদ্ধ বয়সে শেষ সম্বল একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা আব্দুল কাদেরও। সেই সঙ্গে ছোট ছোট দুটি নাতি ও পুত্রবধূর ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাঁদের।
রিয়াজের বাবা আব্দুল কাদের বলেন, ‘সামান্য যে জমিটুকু আছে তা চাষাবাদ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি। যত দিন শরীরে শক্তি আছে তত দিন সংসার চলবে। কিন্তু এরপর সংসার কীভাবে চলবে। নাতিদের ভবিষ্যৎ কী হবে সে আতঙ্কে দিন কাটছে এখন।’
শুধু রিয়াজ হাওলাদারের পরিবারই নয়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর অভিযান ১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়েছেন অনেকেই। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বহু পরিবারেরই অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে। সরকারি সহযোগিতা বড় দরকার তাঁদের।
মুক্তার মতো সুগন্ধা ট্র্যাজেডিতে প্রিয়জন হারিয়েছেন বুড়ামজুমদার ইউনিয়নের আলমগীর হোসেন। অভিযান ১০ লঞ্চে ওইদিন তার বোন রিনা আর ১২ বছরে ভাগ্নি লিমা তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসছিলেন। লঞ্চের ভয়াবহ আগুন তাদেরও জীবন কেড়ে নেয়। মোকামিয়া ইউনিয়নের খাদিজা বেগমের স্ত্রী আরিফুর রহমান ও ৪ বছরের মেয়ে কুলসুমও ফিরেছেন লাশ হয়ে।
রিনা বেগমের ভাই আলমগীর হোসেন বলেন, অসুস্থ বাবাকে দেখতে আমার বোন তার মেয়েকে নিয়ে ওইদিন বাড়িতে আসতেছিল। লঞ্চের আগুল লাগার খবর পেয়ে রাতেই আমরা ঝালকাঠি যাই। কিন্তু আমার বোন আর ভাগ্নির লাশ পাইনি। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ সনাক্ত করি। মেয়ে ও নাতনীর মৃত্যু শোকে আমার বাবাও কিছুদিন পর মারা যান। স্ত্রী সন্তানকে হারিয়ে আমার বোন জামাইও এখন পাগলপ্রায়।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সুহৃদ সালেহীন বলেন, লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। নতুনভাবে সরকারি সহায়তা আসলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব পরিবারের কাছে তা পৌঁছে দেবো।
উল্লেখ্য, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় ৪৯ জন। এর মধ্যে ১৭টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে বরগুনায় ২৩ জনকে দাফন করা হয়। এর ভিতরে নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে গত এক বছরে ১৪টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।
আরএইচ/এনএন