'আগের মতো আর খেজুর গাছ নেই। অন্যদিকে গাছে রসও কমে গেছে। যে পরিমাণে শ্রম দিতে হয় সে পরিমাণে আমরা লাভ করতে পারি না। তবুও পেটের দায়ে পূর্বপুরুষ থেকে পেশাগত কারণে চালিয়ে যাচ্ছি এই ব্যবসা।'
রস সংগ্রহ করে গুড় প্রস্তুতকালে কথাগুলো অবজারভারকে বলছিলেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর-কুরপালা রোডের পাশেই গুড় প্রস্তুতকারী গাছি আনোয়ারুল ইসলাম (৩৮)।
তিনি বলেন, 'চাহিদা বাড়ছে। বর্তমান বাজারে আখের গুড়, চিনি যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে তার চেয়ে মানসম্পন্ন খেজুরের গুড়ের দাম এ বছর কিছুটা বেশি হবে।'
আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোঁপ ঝাঁড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ। কোন পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃৃতিক ভাবে বেড়ে উঠতো এসব খেজুর গাছ। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামাঞ্চলে গাছি পুরোদমে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রসের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। খেজুরের রসে তৈরি হতো নানা প্রকার পিঠা-পায়েস। বাড়িতে বাড়িতে দেখা যেত উৎসব।
এছাড়া, খেজুরের পাতা দিয়ে আর্কষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি করা যায়। এমনকি জ্বালানি কাজেও রয়েছে এর ব্যাপক ব্যবহার।
কিন্তু বর্তমানে কোটালীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কোথাও তেমন খেজুরের গাছ চোখে পড়ে না। কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। নির্বিচারে ও অপরিকল্পিত ভাবে খেজুর গাছ কর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতন, গাছ ও রসের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারী ও সচেতনতা না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন বিলুপ্তির পথে।
একাধিক সচেতন মহল বলেন, খেজুর রস ও গুড়ের বহু খ্যাতি রয়েছে। খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। জনপদের সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ার কারণে পরিবেশবান্ধব এ খেজুরের গাছ ইট ভাটা, বেকারী ও কারখানার রাহু গ্রাসে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ায় যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ার কথা তা নির্বিচারে নিধন করায় খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমেই যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হিমাংশু কুমার পান্ডে অবজারভারকে বলেন, 'এখন খাঁটি গুড় পাওয়া দুষ্কর। দিন দিন গাছের সংখ্যা কমায় চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম।' ঐতিহ্যকে স্বরণ করে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় অবজারভারকে বলেন, 'গত বছরের চেয়ে এবার গাছের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। খেজুর গাছের জন্য বাড়তি কোন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না বলে কৃষকদের বাড়ির আশপাশ, জমির আইল, পুকুর পাড় এবং সড়কের ধারে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ প্রদানের কার্যক্রম কৃষি বিভাগের চলমান রয়েছে।'
শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. এনায়েত বারী অবজারভারকে বলেন, 'গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙিনায় খেজুরের গাছ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য ছিল। ঝোঁপ ঝাঁড়ে, ক্ষেতের আইলে, গ্রামের মেঠোপথের দুই ধারে অসংখ্য খেজুরের গাছ কোন পরিচর্যা ছাড়া বড় হতো। জনপদের সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ার কারণে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন বিলুপ্তির পথে।'
কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ অবজারভারকে বলেন, 'প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে খেজুর গাছের ভূমিকা অপরিসীম। এক সময় সন্ধ্যাকালীন সময়ে গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠতো। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালী তৈরি করতেন। যার সাধ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্যই সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও তা বাস্তব। এই উপজেলায় এখনো বেশ কিছু খেজুরের গাছ দেখা যায়। পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর বাগান গড়ে তোলা হলে কৃষকরা লাভবান হবে।'
-এমএ