For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

জালিয়াতি করে সরকারি জমি হাতিয়ে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা

Published : Tuesday, 20 December, 2022 at 5:35 PM Count : 297

গাজীপুরেশ্রীপুর উপজেলার সবচেয়ে অবহেলিত গ্রাম নিজমাওনা। গ্রামের সিংহভাগ লোকজন কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। গ্রামটিতে ঘনবসতি নেই, বেশ কিছু দূরে দূরে মানুষের বসতি। উঁচু টিলায় সমৃদ্ধ গ্রামটি ঘন অরণ্যে ঘেরা।

এ গ্রামের সিংহভাগ জমিই সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। মানুষের সরলতার সুযোগে সরকারি জমির উপর নজর এখন ভূমিদস্যুদের। মোটা অংকের টাকার লোভে নিজেদের ইচ্ছেমতো জমি পরিস্কার করছেন, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তা তুলে দিচ্ছেন বিভিন্ন মালিকদের কাছে। শুধু দখল দিয়েই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না, আশ্রয় নিচ্ছেন জালিয়াতির। সরকারি রেকর্ডপত্র জালিয়াতি করে জমির রেজিষ্ট্রেশন, নামজারী, জোত সবই খুলছেন। প্রশাসনের নজরদারীর অভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় এভাবে বেহাত হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি।

স্থানীয় ভূমি অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর মৌজার সাবেক ৮১৫ দাগে মোট জমি ২২৩ দশমিক ২৫ একর। এর মধ্যে ১ নং খতিয়ানভুক্ত সরকারি জমি ১৮৬ দশমিক ০২ একর। ওই জমি থেকে বেশ কিছু জমি ব্যক্তির অনুকূলে বন্দোবস্ত দিলেও অধিকাংশ জমি এখনও কাগজপত্রে সরকারি। 

অনুসন্ধানে যা মেলে
নিজমাওনা গ্রামের জমির উদ্দিনের ছেলে সাহাব উদ্দিন ১৯৭৯ সালের ৮৯৮৫ নং বন্দোবস্ত দলিলের মাধ্যমে সরকারি এক একর ২২ শতাংশ জমির মালিকানা হন। পরে তিনি ২০১০ সালে ১০৯৬৪/০৯-১০ নথিমূলে নিজ নামে নামজারী করেন যার জোত নং ১১৮। এ জমি ভোগদখলে থাকার পরও একই দলিল ব্যবহার করে তার নামে আরও দেড় একর জমি ৩৭০৭/০৮-০৯ নথিমূলে নামজারী করে আরও একটি জোত খোলা হয় যার নাম্বার ১১২। পরে ১১২ জোত ব্যবহার করে জমি বিক্রি করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির অনুকূলে। সম্প্রতি সাহাব উদ্দিন তার নামে দুটি জোতে দুই একর ৭২ শতাংশ জমি ভূমি অফিসের খাতায় রয়েছে জানতে পেরে সেখানে যান।
তিনি ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি একটি দলিলের মাধ্যমে এক একর ২২ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। সেটির নামজারিও করেছেন অন্য জমিও জোত তার নামে কিভাবে এলো তা জানতে চাইলে ভূমি কর্মকর্তারা কোন উত্তর দিতে পারেননি।

সাহাব উদ্দিন সোমবার এই প্রতিবেদককে বলেন, 'এটি কেমন কথা, আমি জানি না অথচ আমার নামে ভূমি অফিসে জোত খোলা হলো। সেটি ব্যবহার করে জমিও বিক্রি হচ্ছে, নামজারীও হচ্ছে।'

তার বন্দোবস্ত দলিল কিভাবে বাইরে গেল সে বিষয়ে তিনি বলেন, 'স্থানীয় সিরাজ নামের এক ব্যক্তিকে তিনি নামজারী করতে দিয়েছিলেন। পরে দীর্ঘদিন ঘুরিয়ে তাকে তার দলিল ফেরত দেন। হয়তো অসৎ উদ্দেশ্যে তার দলিল দিয়ে ভূমিদস্যুরা তার অজান্তে নামজারী করে আরও একটি জোত খুলে থাকতে পারেন।'

অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামেও ভূমি অফিসে জোত মাওনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নামজারী জমাভাগ ৩৯৭৪/০৮-০৯ নথিমূলে দুই একর জমি নামজারী জমাভাগ করা হয়। ১১১ নং জোত খোলা হয় গোলাম মোস্তফার নামে। তার বাবার নাম মৃত আব্দুর রহিম। গ্রাম উল্লেখ করা হয় গাজীপুর, উপজেলা শ্রীপুর, জেলা গাজীপুর। অথচ গোলাম মোস্তফা নামের ব্যক্তিকে এলাকায় কেউ চেনেন না। এমন লোক আদৌ আছেন না কি তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে স্থানীয়দের।

গোলাম মোস্তফার এই জোত ব্যবহার করে জমি বিক্রি হচ্ছে নিয়মিত। ১১২ ও ১১৮ জোত ব্যবহার করে ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯সালে শ্রীপুর রেজিষ্ট্রি অফিসে ১৪৮১৪নং দলিলের মাধ্যমে ৩একর৫০শতাংশ জমি রেজিষ্ট্রি হয়েছে। পরে ১২০২/১১-১২ নথিমূলে তা নামজারী হয় যার জোত নং ১৪৬। সে জমি জনৈক মঞ্জুর হোসেন ক্রয় পূর্বক ৩৩১৩/১৬-১৭ নথিমূলে নামজারীর আবেদন করলেও ভূমি কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়েছিলো। যদিও পরে ভূমি কর্মকর্তার অজ্ঞাতসারে সেখানে মুঞ্জুর হোসেনের নামে জোত খোলা হয়, যার নং ২২১। উক্ত জোতের মাধ্যমে তিনি ৩একর ৮৫শতাংশ সরকারী জমি হাতিয়ে নিয়েছেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা।   

সে সময়কার ভূমি কর্মকর্তা এখন ফের একই ভূমি অফিসে কর্মরত ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব। তিনি বলেন, এটি খুবই হতাশার। মঞ্জুর হোসেন নামজারীর আবেদন করলেও আমি প্রস্তাবপত্র না দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। পরে কিভাবে জোত খোলা হলো কিছুই বুঝতেছি না। এছাড়াও ভূমি অফিসে থাকা বন্দোবস্ত নামজারীর তথ্যে বিভিন্ন ঘষামাজা রয়েছে। কিভাবে কি হলো এর ধারণাও পাচ্ছি না।'

তিনি আরও বলেন, 'ভূমি অফিসে থাকা সরকারী জমির তথ্য সংবলিত নথির অবস্থা তেমন ভালো নেই, অধিকাংশই ছেড়া ও জরাজীর্ণ।'

কারা জড়িত এসব অপকর্মে
পুরো এলাকায় ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় খোরশেদ ফকির, গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ড সদস্য আমজাদ হোসেন ও দলিল লেখক আইনউদ্দিন ফকির, ফজলুল হক ফকির এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন ভাবে ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে নামজারী ও জমাভাগ, জোত খোলে কাগজপত্র তৈরী করেন, বন জঙ্গল পরিস্কার করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জমির দখল নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট মালিকদের কাছে জমি বিক্রিতে সহযোগিতা করে থাকেন। এলাকার কেউ বাধা দিতে এলে তাদের প্রদান করেন হুমকী। শুধু সরকারি জমি হাতিয়ে নিতে তারা স্থানীয় ভাবে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যেখানে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জড়িত।

এ বিষয়ে গাজীপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, 'জালিয়াতির সঙ্গে তারা কেউ জড়িত নন। তারাও চান এ জালিয়াতির চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হোক। তবে সরকার যদি তদন্ত করে সেখানে তারা নিজেদের স্বাক্ষ্য উপস্থাপন করবেন।'

সরকারি জমি ভোগদখলে থাকা ও নতুন করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের বিষয়ে মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'আমি জমির সকল কাগজপত্র সঠিক দেখেই ক্রয় করেছি। এখন এসব বলা অবান্তর কথা। সরকার যদি তদন্ত করতে চায় তাহলে আমরা আমাদের জবাব দাখিল করবো।'

বিভিন্ন ভুয়া জোতের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এগুলো কি সাধারণ মানুষ করতে পারে, অবশ্যই সঠিক দেখেই ভূমি অফিসের লোকজনই করেছেন।'

এভাবে সরকারি জমি ব্যক্তিরা দখল করে নিচ্ছেন এ বিষয়ে স্থানীয় রুহুল আমিন বলেন, 'ভূমিদস্যু এ চক্রটি শুধু এলাকার মানুষদের ঘুম হারাম করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা অব্যবহৃত পড়ে থাকা সরকারি জমি পরিস্কার করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দখল করছেন। আমরা ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর সরকারি এ জমি রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছি।'

এলাকার হতদরিদ্র বাবুল ফকির বলেন, 'আমরা পূর্বপুরুষসহ বংশানুক্রমিক ভাবে কিছু জমিতে চাষাবাদ করে আসছি। সম্প্রতি ভূমিদস্যু চক্রটি এ জমিতে দখল নিতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া শুরু করেন। পরে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে তারা পিছু হটে।'

তিনি দাবি করেন, 'এ চক্র খুবই শক্তিশালী। তাদের কারণে এলাকায় বাস করা এখন কঠিন হয়েছে।' তাই আমরা সরকারের কাছে সরকারি জমি রক্ষার দাবি জানাই। 

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, 'এ বিষয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে সরেজমিনে পরিদর্শন করে তদন্তপূর্বক মতামত দিতে নির্দেশ দিয়েছি। রিপোর্ট এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, 'এ বিষয়ে তদন্ত করে এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এছাড়াও সরকারি জমি পুনরুদ্ধারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,