রংপুরের টুপি এখন ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রমজানের কারণে এর চাহিদাও বেড়ে গেছে। আর এতে গ্রামের স্বামী পরিত্যাক্তা এবং হতদরিদ্র প্রায় ১৫ হাজার মহিলার কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের আর এখন অভাবে পড়তে হয় না। থাকতে হয় না অনাহারে, অর্ধাহারে।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সাব্দী গ্রামে ১৯৯৮ সালে টুপির কাজ নিয়ে আসেন জহির উদ্দিন। ভোলা থেকে আসা আগন্তুককে কেউ জায়গা দিতে না চাইলেও বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দেন মৃত আবোর উদ্দিন। সেই বাসায় থেকেই প্রথম শুরু হয় নারীদের সুক্ষ হাতের সেলাইয়ে তৈরি টুপির কাজ। শুরুর দিকে কয়েকজন নারী থাকলেও ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মঘধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই টুপির চাহিদা অনেক বেশি থাকায় পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জহিরকে। বর্তমানে ওমানেই রয়েছে তার ২টি টুপির দোকান।
উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের খোপাতি গ্রামের হাফেজ আবদুল আউয়াল (৬০)। চাকুরি করতেন সিলেট টেক্সটাইল জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে। পরে বদলি হয়ে আসেন কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলে। এরপর সরকার ২০০২ সালে বাধ্যতামুলক অবসরের ঘোষণা দিলে তিনি অবসরে যান। অবসর নেওয়ার পর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা পান। কিছুদিন বসে থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেন। চিন্তা করলেন এভাবে বসে বসে থাকলে সব টাকাই একদিন শেষ হয়ে যাবে। ভাবতে থাকেন, কি কাজ করা যায়। এরপর মনে মনে ভাবেন যে টাকা পয়সা রয়েছে, সে টাকা দিয়ে এমন কিছু করবেন যাতে নিজে এবং সমাজের অবহেলিত মানুষও উপকৃত হয়। তারাও যাতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।
পরবর্তীতে ২০০৫ সালে তার পূর্ব পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে ফেনি চলে যান। সেখান গিয়ে প্রায় ২ মাস টুপি বানানোর প্রশিক্ষণ নেন ব্যবসায়ী আবুল খায়েরের কাছে। এরপর তার কাছ থেকে ৩০০ পিস টুপি বানানোর কাপড় ও অন্যান্য জিসিনপত্র নিয়ে আসেন বাড়িতে। তিনি নিজে এবং বাড়ির পাশের কয়েকজন মহিলাকে সাথে নিয়ে সেগুলোর কাজ শেষ করে আবার তা ফেনিতে দিয়ে যান। কাজ দেখে মালিক আবুল খায়ের বেশ খুশি হন। এজন্য প্রতিটি টুপি তৈরি বাবদ তাকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে তার লাভ হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এভাবে শুরু হয় তার ব্যবসা।
অবসরের ও জমি বন্ধকের প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়ে নিজেই কিনে ফেলেন মোটর চালিত ৫০ টি সেলাই মেশিন। ওইসব মেশিন দিয়ে চলে টুপি সেলাই ও এম্ব্রডারির কাজ। কাউনিয়ার বালাপাড়াতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে করেছেন অফিস ও কারখানা। ফ্যাক্টরির নাম দিয়েছেন “এম এইচ টুপি” কারখানা। এভাবে আস্তে আস্তে তার ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে।
বর্তমানে শুধু কাউনিয়া উপজেলায় নয়, রংপুর সদর, লালমনিরহাটের তিস্তাচর, কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা টুপি বানিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বি করেছেন। এরমধ্যে কাউনিয়া উপজেলার খোপাতি, চানঘাট, পূর্বচানঘাট, বব্লভবিষু, ভূতছাড়া, সাব্দী, হরিশ্বর, পাজরভাঙ্গা, গদাই, তালুকশাহবাজ, নিজপাড়া, মধুপুর, ভায়ারহাট, কুফিরপাড়, শিবু, কুড়িগ্রামের উলিপুর, রাজারহাট, লালমনিরহাট সদর এবং রংপুর সদরের নব্দিগঞ্জ গ্রামের ১০ হাজারের বেশি মহিলা এ কাজ করছেন।
কাউনিয়া উপজেলার ভুতছড়া গ্রামের রমিছা বলেন, স্বামীর আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতাম। বর্তমানে সংসারের কাজের পাশাপাশি সেলাই করে মাসে মাসে প্রায় ৩ হাজারও আয় করি। অবসরটা সময়ে বসে বসে বাড়িতেই কাজ করি।
তিনি আরো জানান, শুরুর দিকে একেকটা টুপি সেলাই কলেছে ২০০ টাকা থেকে ৩০ টাকায়। বর্তমানে কাজ ভেদে টুপি সেলাই করে পাচ্ছেন ৮শ’থেকে ১৫শ’ টাকা।
তিনি জানান, তার কাজ হচ্ছে টুপির চারদিকে মোটা সূতা ঢোকানো। যাকে বলা হয় হাসু। এতে তিনি পান প্রতিটি টুপির জন্য ৭০-৮০ টাকা। এতে তার মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা আয় হয়।
কথা হয় ক্ষুদ্র টুপি ব্যবসায়ী জজ মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মহিলাদের সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। নকশা হয়ে গেলে তা আবার ফেরৎ নিয়ে আসি টাকা দিয়ে। বিভিন্ন কারখানার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আমার কাছ থেকে এই টুপিগুলো কিনে নেয়। এতে মোটামুটি ভালই লাভ আসে।
এব্যাপারে কথা হয় মায়ের দোয়া কারখানার মালিক আসাদের সাথে। তিনি জানান, ওমানের ব্যবসায়ীর সাথে তার সরাসরি চুক্তি হয়েছে। এখন থেকে সরাসরি তিনি নিজেই ওমানে টুপি রপ্তানি করছেন।
তিনি জানান, এখন সপ্তাহে ৪০০-৫০০ টুপি তৈরি হচ্ছে। রমজান উপলক্ষে চাহিদাও বেড়ে গেছে। তিনি জানান, বহন খরচ, মজুরিসহ অন্যান্য খরচ মিলে একটি টুপিতে তার খরচ পড়ছে ১৫০০-২০০০ টাকা। ওই টুপি তিনি বিক্রি করেন ৩ হাজার থেকে ৪হাজার টাকা। এতে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে তার ৫ থেকে ৭শ’ টাকা লাভ টিকছে।
এসআর