দারিদ্রতা জয় করে ছেলেদের এএসপি-ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন বুলবুলি রাণী
Published : Monday, 18 April, 2022 at 3:30 PM Count : 1035
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাটুয়া গ্রামের জীবন যুদ্ধে জয়ী এক সংগ্রামী নারী বুলবুলি রাণী। গাইবান্ধা জেলার মহিমাগঞ্জের দরিদ্র বাবার সংসারের আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে আরেক দরিদ্র পরিবারে বিয়ে হয় বুলবুলি রাণীর। স্বামী যুধিষ্ঠির চন্দ্র বর্মন ছিলেন ভিটেমাটি হীন দিনমজুর। অল্পদিনেই বুলবুলি রাণী তিন সন্তানের জননী হন। দুই ছেলে বিমল চন্দ্র বর্মন ও জয় চন্দ্র বর্মন আর মেয়ে লক্ষ্মী রানী।
পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সংসারের খরচ। তাই স্বামীর পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। সংগ্রামী এই নারী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। আবার নিমেষেই সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যেত। কারণ পরিবারের পাঁচ সদস্যের পেটের ভাত যোগাতেই যেখানে তাদের হিমশিম খেতে হয়। সেখানে ছেলে-মেয়েকে কিভাবে মানুষ করবেন তিনি।
কিন্তু বুলবুলি রাণী ছিলেন নাছোরবান্দা। ছেলে-মেয়েকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর নন্দীগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন তাদের।
আরও বাড়তে থাকে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। তখন অল্প বয়সের মেয়েটাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। আর দুই ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। বড় ছেলে বিমল চন্দ্র বর্মন এসএসসিতে জিপিএ-৪.৮১ ও ছোট ছেলে জয় চন্দ্র বর্মন জিপিএ-৫ পান। এইচএসসি পরীক্ষায় বড় ছেলে জিপিএ-৪.১০ ও ছোট ছেলে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ছেলেদের নিয়ে তার স্বপ্ন আরও বাড়তে থাকে।
বড় ছেলে বিমল চন্দ্র বর্মন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হন। আর ছোট ছেলের এইচএসসি পাশের পর ভর্তি ফরম তোলার মতো একটি টাকাও ছিল না বুলবুলি রাণীর কাছে। নিরুপায় বুলবুলি রাণী ঘুরতে থাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে।
অবশেষে নন্দীগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল বারি বারেক তাকে এক হাজার টাকা দেন ছেলের মেরিন একাডেমীর ফর্ম তোলার জন্য। ছোট ছেলে জয় চন্দ্র বর্মন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে ভর্তি হয়।
দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের উপার্জনে আর চলে না। তখন বিভিন্ন স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন সংগ্রামী এই নারী।
আজ জীবন যুদ্ধে জয়ী সংগ্রামী এই নারীর দুই ছেলে ও ছেলের বউ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন। তার বড় ছেলে বিমল চন্দ্র বর্মন পুলিশের এএসপি আর ছেলের বউ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ছোট ছেলে জয় চন্দ্র বর্মন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চীনের একটি জাহাজ কোম্পানিতে কর্মরত আছেন।
এই সংগ্রামের স্বীকৃতি সরুপ বুলবুলি রাণী ২০২০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ২০২২ সালে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কারও পান।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার জয় চন্দ্র বর্মন বলেন, অনেক লড়াই সংগ্রাম করে মা আমাদের মানুষ করেছে। কোন সন্তান তার পিতা-মাতার ঋণ শোধ করতে পারেনা। আর আমার মা-বাবাতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা-বাবা।
বুলবুলি রাণী বলেন, ইচ্ছা থাকলে মানুষের কাছে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। এক কাঠা জমি ছিল না আমাদের। এমনকি অন্যের জায়গায় ছোট একটা ঘরে জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে গেছে আমাদের। স্বামীকে নিয়ে কঠিন লড়াই করে ছেলেদের মানুষ করেছি। অনেকেই আমাকে সাহায্য করেছে। আবার অনেকেই তাচ্ছিল্য করেছেন। আজ আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা আমার ছেলে-মেয়েদের জন্য আর্শীবাদ করবেন।
-একে/এমএ