রাজধানীর তুরাগে গভীর রাতে ও দিনে-দুপুরে চুরি হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। লোহার তৈরি গেট কেটে, তালা ভেঙ্গে বহুতল ভবনের নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে ঘটছে এমন ঘটনা। বেশ কিছু দিন ধরে বেড়েছে চুরি ডাকাতির ঘটনা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তুরাগ থানায় পুলিশের কাছে গেলে যা হয়ে যাচ্ছে নিছক সাধারণ ঘটনা!
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় বাস ডাকাতির ঘটনায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, যেকোনো ঘটনার মামলা থানাকে অবশ্যই নিতে হবে। এ বিষয়ে শক্ত ভাবে বলা হয়েছে মামলা নিতে, না হলে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাবে। সম্পত্তি সংক্রান্ত যেকোনো অপরাধের অভিযোগ নেওয়ার বিষয়টিও বলা হয়েছে।
চুরি হয়ে যাচ্ছে নামীদামী ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। এই তালিকায় রয়েছে গার্মেন্টসের মালামালসহ ফ্যাক্টরির সামনে থেকে চুরি হয়ে যাওয়া কার্ভাডভ্যানও।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনায় থানায় গেলেই নেয়া হয় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অভিযোগ। এটি এন্ট্রি করতেও পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। তদন্তে নেই কোন গতি। ভুক্তভোগীরা দ্বায়িত্বরত অফিসারকে চুরির খোঁজ খবর নিতে ফোন দিলে হন বিরক্ত।
তারা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের এতো টাকার মালামাল খুঁইয়ে যখন মামলা করতে থানায় যাই মামলা নেয়া হবে না বলে নানা অজুহাত দাঁড় করায় পুলিশ।
এমনই একজন ভুক্তভোগী রাজধানী তুরাগের বাউনিয়া পুকুর পাড় এলাকার মাদার্স প্রিন্টার্স ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী মো. তাইজুল ইসলাম খান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর রাতের মধ্যে ফ্যাক্টরির সামনে থেকে পাঁচ হাজার পাঁচশ পিস গেঞ্জির কাপড়সহ কার্ভাডভ্যানটি চুরি হয়ে যায়। গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো ম- ৫১-৩৫৭৫। এ ঘটনায় তুরাগ থানায় মামলা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। পরে তার ছেলে ফাইম উল ইসলাম খান বাদি হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। হারিয়ে যাওয়া গাড়িটির মূল্য ১০ লক্ষ টাকা। আর গাড়িতে থাকা গেঞ্জির কাপড়ের মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকা। সর্বমোট ১৫ লক্ষ টাকার লোকসানে পরে পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমার ফ্যাক্টরির সামনে থেকে মালামালসহ কার্ভাডভ্যানটি চুরি হয়ে গেল আর তুরাগ থানা পুলিশ মামলা নিল না। অনেক ঘোরাঘুরি পর অভিযোগ নেন। তাতেও নেই কোন অগ্রগতি।'
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে, গত দুই মাসে রাজধানীর তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া এলাকা থেকে তালা ভেঙ্গে প্রায় ১২টি মোটরসাইকেল, একটি কাভার্ডভ্যান, ইজিবাইক, তিনটি বাসা বাড়ি থেকে ব্যাটারী চুরির ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো সীমাবদ্ধ রয়েছে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগের মধ্যে। একটিরও হয়নি মামলা। জিডি ও অভিযোগ তদন্তে রয়েছে ধীরগতি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে ও মিলছে না সেবা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ঘটনা কিভাবে হারানোর ঘটনা হিসাবে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা অভিযোগ হয়? এ ঘটনাগুলো চুরি বললেও তো ভুল হবে। সরাসরি ডাকাতির ঘটনা হিসেবে চলে যায়। মানুষের সামনে থেকে কোন কিছু লুকিয়ে নিয়ে গেলে সেটি হয় চুরি।
অপর এক ভুক্তভোগীর সন্ধান মিলেছে আমাদের অনুসন্ধানে। সম্প্রতি তুরাগের বাউনিয়া বটতলা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা বিধবা বৃদ্ধা সানোয়ারা বেগম। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাতে তার গোয়াল ঘর থেকে চুরি হয়ে যায় পাঁচটি গরু। যার মূল্য প্রায় চার লক্ষ টাকা। চুরির ঘটনাটি ব্যাপক সারা ফেলে এলাকা জুড়ে। ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
বিধবা বৃদ্ধা সানোয়ারা বেগম বলেন, 'আমাদের মত গরীবের কেউ নেই। তাই তো আমার এতো বড় ক্ষতি হওয়ার পরও পুলিশ মামলা নেয়নি। কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।'
ভুক্তভোগীর ছেলে সেলিম হোসেন বলেন, 'তুরাগ থানায় গিয়ে মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি কয়েক বার। পরে তুরাগ থানাধীন ডিয়াবাড়ির ফাঁড়ি পুলিশের আশ্বাসে চুপ থাকে বৃদ্ধার পরিবার। কিন্তু আজও কোন খবর পাওয়া যায়নি।'
মোটরসাইকেল হারানো এক ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বাউনিয়ার ভাড়া বাসার গ্যারেজ থেকে টিভিএস স্টাইকার ১২৫ সিসি’র মোটরসাইকেলটি (ঢাকা মেট্রো- হ ৪২২৪৬৩) তালা ভেঙ্গে চুরি করা হয়।
মিজানুর রহমান বলেন, 'তুরাগ থানায় যাই মামলা করতে। কিন্তু ডিউটি অফিসার মামলা নেবেন না বলে নানা অজুহাত দেখান। পরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ১৫ দিন পার হলেও তদন্তের কোন খবর নেই। আমরা থানা পুলিশের কাছে অসহায়।'
এমন আরও কয়েকটি ঘটনা রয়েছে যাদের কেউ থানায় গিয়ে পাননি সেবা। তাদের সবারই একই অভিযোগ থানায় গেলে মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। একটি জিডি করতে গেলেও পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি।
উত্তরা জোনের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ আলম বলেন, 'এমন ঘটনা জানা নেই। আপনি ভুক্তভোগীদের নাম ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেন। আর না হয় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বাকিটা আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার এলাকায় এ ধরনের কোন ঘটনাকে আশ্রয় দেয়া হবে না। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আমাদের দ্বায়িত্ব দিয়েছে সরকার।'
-এমএ