For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

তেল নিয়ে তেলবাজি!

Published : Monday, 28 February, 2022 at 10:53 PM Count : 539



কয়েক দফা তেলের দাম বাড়িয়ে ভোজ্যতেল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তাতেও মন ভরছে না ব্যবসায়ীদের। আবারও তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।  লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১৮০ টাকা করতে চায় ব্যবসায়ীরা।
পবিত্র রমজান মাস ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যু কাজে লাগিয়ে এ খাতের মিলার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চায়। সে লক্ষে বাজারে কৃত্তিম সংকট তৈরি করতে মজুদ বাড়িয়ে বেশি মুনাফার আশায় মিলগেট থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাজারে তেলের সংকটকে কাজে লাগিয়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।  অন্যদিকে মোড়কজাত ভোজ্যতেলের দাম গায়ে লেখা থাকায় মোড়ক খুলে সেসব তেল খোলা তেল হিসেবে খুচরা বাজারে বিক্রি করছেন অনেক খুচরা ব্যবসায়ী।

সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দেয়া তথ্য মতে, খুচরা বাজারে মানভেদে ১৬০-১৬৭ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়বিন তেল।

তবে টিসিবির দেয়া এমন তথ্যের সঙ্গে রাজধানীর খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। ঢাকার কোনো কোনো খুচরা বাজারে এই দামেও ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না।

ভোজ্যতেলের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ১০০ থেকে ৭ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ এ হিসাবে কেজিপ্রতি খোলা ভোজ্যতেলের দাম পড়ে ১৯০ থেকে ১৯৩ টাকা। পাইকারি বাজার থেকে খোলাবাজারে পণ্যটি নিয়ে বিক্রি হবে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা। অথচ সরকারিভাবে নির্ধারিত মোড়কজাত সয়াবিনের মূল্য ১৬৮ টাকা। সরকারিভাবে মোড়কজাত ভোজ্যতেলের দাম এখনো না বাড়ানোর কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোড়কজাত সয়াবিন তেলের বোতল খুলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। চাহিদামতো অর্ডার দিয়ে এখন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে খুচরায়ও সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে এখন ব্যবসায়ীদের আমদানির সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া আমদানিকৃত ভোজ্যতেলের মোট মূল্যের ওপর না করে টনপ্রতি ভ্যাট নির্ধারণ করা হলে বাজারে দাম কমে আসবে।

আমদানিকারক একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, বর্তমানে পাইকারি বাজারে যে দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে, তাতে আমদানিকারকদের কোনো লাভ থাকছে না।

এ বিষয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের জ্যেষ্ঠ পরিচালক মোহাম্মদ তারিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, এ যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্যের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়া, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাহিদা বৃদ্ধি কিংবা সংকট স্বভাবতই বিভিন্ন দেশে প্রভাব ফেলে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর কোনো দেশই ভোজ্যতেলের বুকিং দর প্রস্তাব করছে না। মূলত সরবরাহ সংকট কিংবা সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তায় বুকিং দিতে ব্যর্থ হচ্ছে সরবরাহকারীরা।

জানা গেছে, ১ মার্চ থেকে ১৮০ টাকা লিটার দরে সয়াবিন তেল বিক্রির কথা জানিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি সরকারকে চিঠি দেয় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

তবে তেলের দাম বাড়ছে না জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে রমজানের আগে তেলের দাম আর বাড়ানো হবে না।

তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে  তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করেছেন। তবে কত টাকা বাড়াতে চান সে দামের কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। আমরা তাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছি। রমজানের আগে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আরও বাড়লেও বাড়বে না। বিশ্ববাজারে যদি বাড়েও, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব সেটা সহ্য করার জন্য।’

সরকার নির্ধারিত বর্তমান তেলের দাম
প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৭৯৫ টাকা ও পাম তেলের দাম ১৩৩ টাকা।

তবে বাজারে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। যেমন- বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৬৮ টাকা। খুচরা বাজারে কোন কোন ব্র্যান্ডের এই তেল এখন ১৭০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। এছাড়া খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার ১৪৩ টাকার পরিবর্তে ১৬০-১৬৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১৭-২৪ টাকা বেশি।

সরকার নির্ধারিত দাম থেকে বাড়তি দামে বিক্রি করার বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পুরো বিষয়টি সরকারের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। দেশে সব ধরনের ভোজ্যতেল ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানি ভাল। রমজান সামনে রেখে ইতোমধ্যে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেক পণ্য খালাস করছেন। এ কারণে ভোজ্যতেল নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। দেশে সন্তোষজনক মজুদ রয়েছে।

বিশ্ব বাজারে তেলের দাম
সিএনবিসি জানায়, ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল ১০৫ ডলার। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) ব্যারেল প্রতি দাম ৯৮ ডলার।

তবে, এরপরে দাম কিছুটা কমে ডব্লিউটিআই-এর দাম ব্যারেল প্রতি ৫.০৩ শতাংশ বেড়ে ৯৬.২০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে, ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৪.৭৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল বিক্রি হয়েছে ১০২.৬১ ডলারে।

গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের জেরে ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো ব্যারেল প্রতি তেলের ১০০ ডলারকে ছাড়িয়েছে।

ভোজ্যতেল নিয়ে করা বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন

সাপ্লাই চেনে সমস্যা
সাপ্লাই চেনে বড় সমস্যার কারণে দেশে তেলের দাম বাড়ছে। খোলা ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিলসমূহ সরবরাহ আদেশে প্রদত্ত মেয়াদ ১৫ দিন উল্লেখ থাকলেও তা তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত সময় গ্রহণ করায় ভিন্ন ভিন্ন মূল্যেও এসও বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মিলসমূহ তাদের উৎপাদন ক্ষমতার অধিক পরিমাণ সরবরাহ আদেশ ইস্যু করে থাকে, যা মূল্য বৃদ্ধির সময় ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে দাম বেড়ে যায়। মিল কর্তৃক সরবরাহকৃত এসও হাত বদলের সুযোগ থাকলেও সেকেন্ডারি বাজারে অতি মুনাফা ও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে মিলসমূহ পূর্বে ইস্যুকৃত এসওর মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে নতুন এসওর মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ

ভোজ্যতেলের দাম কমাতে পাঁচটি সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। ওই সুপারিশে বলা হয়েছে- ভোজ্যতেল সরকার ঘোষিত একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা সহজীকরণ নিমিত্তে সরকার কন্ট্রোল এসেনসিয়াল কমোডিটিস এ্যাক্ট-১৯৫৬ অধীনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ জারি করেছে। ওই আদেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা পদ্ধতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে, যা অনুসরণ করা হলে ভোজ্যতেলের সাপ্লাই চেন অধিকতর কার্যকর করা সম্ভব। মিল মালিকদের উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত এসও ইস্যু না করণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণে শতভাগ কনজ্যুমার প্যাকের ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কর্পোরেট ক্রেতার জন্য ১০-১৫ লিটারের টিন এবং অধিকতর কম ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতার জন্য ২৫০-৫০০ মিলি লিটারের পাউস প্যাকের প্রবর্তন করে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা যেতে পারে। ভোজ্যতেল বিক্রির নিমিত্ত ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের ইস্যুকৃত সাপ্লাই অর্ডার (এসও) যে এলাকায় ভোজ্যতেল বিক্রির জন্য ইস্যু করে সে এলাকা ব্যতিত অন্য এলাকায় যেন ভোজ্যতেল সরবরাহ না করে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। মিলগেট কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য কমপক্ষে ১০ দিন স্থিতিশীল থাকে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ভোজ্যতেলের শুল্কহার পদ্ধতি
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। এ ছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদত্ত ছিল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর, উৎপাদন ও মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অথবা বিক্রয় মূল্যেও ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে ভ্যাট এক স্তরে নামিয়ে আনার জন্য আবেদন করেছে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভ্যাট এক স্তরে নামিয়ে আনতে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে।

খাদ্যসামগ্রীর দাম না বাড়াতে ২৩ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি
গত মঙ্গলবার ২৩ বিশিষ্ট বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, প্রায় ২ বছর যাবৎ করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সীমাহীন আর্থিক দুরাবস্থায় নিমজ্জিত। কারোনা কালে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে, আয় কমেছে অনেকের। এরকম পরিস্থিতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মূল্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নতুন করে ভোজ্য তেল বিশেষত সাধারণ মানুষ যে তেল ব্যবহার করে সয়াবিন ও পামঅয়েল তেলের মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও কষ্টকর করে তুলবে।

বিবৃতির মাধ্যমে সকারের কাছে তারা দুটি দাবি তুলে ধরেন-  ১. ভোজ্যতেলসহ খাদ্য সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ২. পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা যাবে না।



« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,