'এখন তো যাবার মত কোনো জায়গা নেই'
Published : Monday, 15 July, 2019 at 10:43 AM Count : 562
কুটির পাড়। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীর ঘেষা ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকা। গত শুক্রবার দুপুরে তিস্তার পানি যখন বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তখনও ঘরটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন শাহিদা। কিন্তু পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার সে আশাও ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। সহসাই খড়ের বেড়া আর বাঁশের খুটি নরম হয়ে দেবে যেতে থাকে। যেন ধ্বসে পড়ার অপেক্ষা। অবশেষে রোববার সকাল থেকে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ভেঙে ফেলতে শুরু করেন দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে।
কোথায় যাবেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠলেন, 'এখন তো যাবার মত কোনো জায়গা নেই।'
পাশেই থাকা আরেকজন বললেন, 'ওই স্পার বাঁধের ওপর আপাতত ওরা থাকবে।'
শাহিদা বেগমের বাবা, শ্বশুড় সবার বাপ-দাদার ভিটে গেছে তিস্তার গর্ভে। বিয়ে হয়েছে প্রায় ৮ বছর। দিনমজুর স্বামী আজিজুল ইসলামের পাঁচ বছর হলো বসবাস করছেন এই কুটির পার এলাকায় স্থানীয়দের তৈরী বালির বাঁধের রাস্তার পাশে। শাহিদা-আজিজুলের তিন সন্তান। বড় ছেলে সাইদুল, বয়স পাঁচ বছর। মেজো ছেলে সাইফুল, বয়স চার বছর। পাঁচ মাস হলো তাদের আরও একটি ছেলে সন্তান হয়েছে। তিন ছেলেকে নিয়ে কৃষি মজুরি করে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের।
মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তার পাড় ঘেষা চন্ডিমারী, কুটির পাড়, বাগডোরা, গোবরধন এলাকাগুলো ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকা। বছর বছর বন্যা আর নদী ভাঙ্গনের ফলে এই অঞ্চলটির শত শত বসতবাড়ি, আবাদি জমি বিলীন হয়। গত চার দশকে এখানকার কত মানুষ নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে, তার হিসেব কেউই দিতে পারেনি। ভাঙ্গন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৬ সালে দিকে চন্ডিমারী থেকে মারাইরহাট পর্যন্ত ৫টি স্পার বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয় না কুটির পাড় এলাকাটি। চন্ডিমারী প্রথম স্পার বাঁধ থেকে গোবরধন দ্বিতীয় স্পার বাঁধটির মাঝের স্থানটি কুটির পাড়। স্থানটির ভাঙ্গন থেকে বাঁচতে একটি বালুর বাঁধ তৈরী করে এলাকাবাসী। যেটি নদী পাড়াপাড়ের রাস্তা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। সেই বালুর বাঁধের একপাশে ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘর আর একটি খড়ের চালা তুলে বসবাস করে আসছিল শাহিদা-আজিজুল দম্পতি।
রোববার বেলা আড়াইটায় সরেজমিনে বালুর বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আজিজুল ঘরের খড়ের বেড়া, খাটসহ অন্যান্য আসবাবপত্র নৌকায় তুলতে ব্যস্ত। ততক্ষণে ঘরের টিনের চালা খোলা হয়ে গেছে। শাহিদাদের মত যারা ভূমিহীন তাদের অনেকেই ঘর তুলেছিলেন এই বালুর বাঁধের দুই পাশে। চারদিকে সেইসব মানুষজনও বাড়িঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত। এসব আয়োজনের মধ্যেই শাহিদা খোলা আকাশের নীচে তাদের ঘরের জায়গাটির একটি ভাঙ্গা খাটের ওপর বসে তার পাঁচ মাসের কোলের সন্তানকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন। পরে কাছে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
শাহিদা জানায়, বাবার অভাবের সংসারে পাত্র পাওয়া মাত্রই তড়িঘড়ি করে আজিজুলের সঙ্গে বিয়ে দেন ১২ বছর বয়সী শাহিদার। আজিজুল কখনো অন্যের কৃষি জমিতে দিনমজুরি, কখনো ধান কাটার মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে গিয়ে আয়-রোজগার করে আনেন। তাতেই চলে পাঁচজনের সংসার। গত বুধবার প্রথম বানের পানি এলে কোনোরকমে রাত পার করেন। কিন্তু শুক্রবার রাতারাতি তিস্তার পানি বাড়লে নির্ঘুম কাটে দুই রাত। খেয়ে না খেয়ে বন্যার পানিতে ঘরের ভেতর খাটের ওপর চুলা তুলে চলে রান্না। কিন্তু শনিবার থেকে ঘরে থাকাও দায় হয়ে ওঠে। সবশেষ রোববার বাড়ি ভেঙ্গে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় শাহিদার পরিবার।
শাহিদা বলেন, 'দশ কেজি চাউল ইলিপ (রিলিফ) পাইচি। কাইল তাকে (তাই) ঘরের ভেতরেতে (ভিতরেই) একবেলা ভাত আন্দি (রান্না করে) সবায় মিলি খাইছি। আইজ (আজ) থাকি কি খামো (খাবো), কোনটে (কোথায়) থাকমো (থাকবো) কবার না পাঁও (পারি)।'
-এমএ