For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

মাঠে চাষ হয় না মিনিকেটের, অথচ বাজারে সয়লাব

Published : Tuesday, 7 May, 2024 at 12:39 PM Count : 426

বাজারে সবচেয়ে বেশি দামি সেদ্ধ চিকন মিনিকেট চাল। বাহারি অনেক নামেই বিক্রি হয় এই মিনিকেট চাল। বাজারে চালের দাম বাড়াতে চকচকে, মসৃন, চিকন এই চালকেই দীর্ঘদিন ধরে জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে আসছে মিলার ও কর্পোরেট কোম্পানীগুলো। 

পাঁচ বছরে এই চালের দাম বেড়েছে দেড় গুন। দীর্ঘদিন ধরে এই চাল খেলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে বলছেন পুষ্টিবিদগণ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে ৬৮ ধরনের হাইব্রিড, ৫৭ ধরনের উফশী এবং ৩৫ ধরনের স্থানীয় চাল বাংলাদেশের মাঠে চাষ হলেও চাষ হয় না মিনিকেট। 

বাজার ঘুরে দেখা যায়, আঠাশ, উনত্রিশ, স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, পাইজাম, কাটারি, সিদ্ধ কাটারি, সিদ্ধ বাসমতি, নাজিরশাইল বিভিন্ন নামে খোলা বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে। গরীব মানুষের মাঝে আঠাশ, স্বর্ণা, পাইজাম, উনত্রিশ চাল সুপরিচিত হলেও মধ্যবিত্ত ও ধনী শ্রেণির মানুষের কাছে সুপরিচিত নাম মিনিকেট। আমিন, তহুরা, কিষান, এসিআই, ঈশান, প্রিমিয়াম বিভিন্ন ব্রান্ডের মিনিকেট চাল বাজারে পাওয়া যায়। 
মিনিকেট চাল কোন ধান থেকে তৈরি হয় জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা এ ব্যাপারে কিছু জানি না। আমরা দিনাজপুর, নওগা থেকে এসব মিনিকেট চাল নিয়ে আসি। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন রকমের মিনিকেট চাল তৈরি করে থাকে। চালের ধরণ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়। সব কোম্পানির মিনিকেট চাল সমান নয়। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য ও বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতের চিকন চালকে টার্গেট করে অটোরাইস মিল ব্যবসায়ীরা। আমন, আউশ, বোরো মৌসুমে চাষীদের কাছ থেকে সরকারি দামের থেকে বেশি মূল্য দিয়ে ধান সংগ্রহ করেন এই অটো রাইস মিল মালিকরা। এরপর পলিশিংয়ের মাধ্যমে চালকে চিকন ও উজ্জ্বল করা হয়। এতে বেশির ভাগ সময় চালের উপরের পুষ্টিকর স্তর নষ্ট হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদেরা। 

শুধুই পুষ্টিগুণ নষ্ট হওয়া নয়, পলিশ করা এই চকচকে চাল বাজারে বিক্রি হয় চড়া দামে। যে চাল ভোক্তাদের পাওয়ার কথা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে, এই চালই ভোক্তারা কিনে খাচ্ছেন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিপ্রতি। 

বিগত দিনের চালের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মোটা চালের দাম হয়েছে দ্বিগুন। পাইজাম, আঠাশ, ঊনত্রিশ, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে দেড় গুন। ২০১৯ সালে পাইজাম, আঠাশ, ঊনত্রিশ, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা চালের খুচরা মূল্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সে সময় মিনিকেট চালের বাজার মূল্য ছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। নাজিরশাইল চালের মূল্য ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। সিদ্ধ কাটারি, সিদ্ধ বাসমতি চালের বাজার মূল্য ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। ভালোমানের চিনিগুড়া চালের মূল্য ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। 

২০২৪ সালে পাইজাম, আঠাশ, ঊনত্রিশ, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং মিনিকেট চালের বর্তমান বাজার মূল্য ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। 

তবে দৌরাত্মে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আছে বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির প্যাকেটজাত চালের দাম। খোলা বাজারে ভালো মানের নাজিরশাইল চাল ৬৭ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হলেও প্যাকেটজাত নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। এছাড়াও খোলা বাজারে ভালো মানের চিনিগুড়া চাল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও চাষী, এসিআই, তীর, নীলসাগর, পুষ্টি, ফ্রেশ, রুপচাঁদা, পার্বনসহ বিভিন্ন প্যাকেটজাত চিনিগুড়া চাল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে।

খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুর বিভাগের আট জেলায় আমন ও বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহ করা হয় যথাক্রমে এক লক্ষ ৬৪ হাজার ৯৮১ দশমিক ৩০ ও তিন লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৮ দশমিক ২৪ মেট্রিক টন। সেই অর্থ বছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মতে, আট জেলায় চাল উৎপাদন হয়েছে ৬৬ লক্ষ ৮২ হাজার ৮০৭ মেট্রিক টন। হিসেব মতে বাকি ৬১ লক্ষ ৫০ হাজার ৭২৭ দশমিক ৪২ মেট্রিক টন চালের বেশির ভাগই মজুদদারের হাত দিয়ে মিলারের কাছে পৌঁছে যায়।

এছাড়াও, ২০২১-২২ অর্থবছরই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক সংগৃহীত চালের পরিমাণ চার লক্ষ ৮০ হাজার ৯২৩ দশমিক ২১ মেট্রিক টন। একই অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ওই অর্থবছরে রংপুর বিভাগে চাল উৎপাদন হয়েছে ৬৪ লক্ষ ৫৩ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন। হিসেব মতে ওই বছরেও মজুদদারের হাত দিয়ে মিলারের কাছে পৌঁছেছে ৫৯ লক্ষ ৭২ হাজার ১৮০ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টনের সিংহ ভাগ। 

এছাড়াও, ২০২০-২১ অর্থবছরে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চাল সংগ্রহ হয়েছে দুই লক্ষ ৯২ হাজার ৯০৯ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন চাল। ওই অর্থবছরে বিভাগে চাল উৎপাদন হয়েছে ৬২ লক্ষ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। ফলে মিলারদের কাছে পৌঁছেছে ৬০ লক্ষ চার হাজার ৯০ দশমিক ২৯ মেট্রিক টন চালের বেশির ভাগই। এই মজুদকৃত চালের অর্ধেকের বেশির ভাগ ব্যবহৃত হয় মিনিকেট চাল তৈরিতে। 

রংপুর অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাশেম আলী ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'রংপুরে খুব বেশি অটো রাইস মিল নেই। যারা আছে তারা মিনিকেট চাল তৈরি করে না। মিনিকেট চাল বেশির ভাগ আসে দিনাজপুরের অটো রাইস মিলগুলো থেকে।'

মিনিকেট চাল তৈরিতে পলিসার হিসেবে কি কি ব্যবহার করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সরকারি বিধি মোতাবেক চালের উপরে অংশের আট ভাগ পালিশ করার নিয়ম আছে। কিন্তু অটো রাইস মিল মালিকরা এই নিয়মটা মানে না। মিনিকেট চাল তৈরির সময় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের সাথে ফিটকিরি ও ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়।'

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট প্রয়াসের নিউট্রিশনিষ্ট সুমাইয়া সিরাজী ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'রিফাইন্ড চালের সর্বপ্রথম ফাইবার নষ্ট হয়ে যায়। যা শরীরের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ভিটামিন বি, থায়ামিন, মিনারাল, খনিজগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রিফাইন্ড চালের মধ্যে শর্করার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়ে যায়। আমাদের দেশের মূল খাদ্য ভাত। তাই এই চাল খেলে শরীরে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং দীর্ঘদিন ধরে এই পলিশ করা চাল খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। এসব চাল রিফাইন্ড করতে যে রাসায়নিক পদার্থগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই আমাদের কাছে ডায়াবেটিস রোগী এলে আমরা লাল চাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। অনেকে বলেন চিকন চাল বা মিনিকেট ছাড়া খেতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে তাদের ভাতের মাড় ফেলে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।'

বাজারে পুষ্টিগুনহীন মিনিকেট চাল সয়লাব হলেও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

এ ব্যাপারে রংপুর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা অন্তরা ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমাদের লোকবল নেই। আমরা চাইলেও কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করতে পারবো না। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে আমরা অভিযান চালাতে পারবো। তবে মিনিকেট চাল নিয়ে এভাবে ভাবা হয়নি।'

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,