চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার। ভরা মৌসুমেও দেখা নেই পর্যটকদের। অথচ গত মাসের মধ্যবর্তী সময়ও জেলার যেসব পর্যটন কেন্দ্র সকাল-সন্ধ্যা কোলাহল মুখর ছিল, সেসব এখন সুনসান নীরবতা। অলস সময় পার করছেন দের শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, মোটেল, রিসোর্টের কর্মীরা।
এতে মৌসুমের শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। টানা অবরোধ, হরতাল ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায়ে এমন অবস্থা বলে জানান তারা। ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন কোটি টাকা বলে জানান শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী সেলিম আহমেদ।
শুক্রবার জেলার বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টে দেখা গেছে, বেশির ভাগ হোটেল রিসোর্টে কোনো পর্যটক শূণ্য। পর্যটন নগরীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান খালি, দেশী- বিদেশি কোন পর্যটক নেই।
জেলার অন্যতম পর্যটন স্পটগুলো হলো- কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর স্মৃতিসৌধ, মণিপুরী পাড়া,হামহাম জ্বল প্রভাত,ছয়সিড়ি দিঘি,ক্যামেলিয়া লেক,পাত্রখোলা লেক,পদ্মছড়া লেক,বামবুতল লেক,হরিনারায়ন দিঘি, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে সবুজ চা বাগান, রাবার বাগান, বধ্যভূমি একাত্তর চত্বর, হাইল হাওর, বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাওর, মুন ব্যারেজ। সম্প্রতি এসব কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে প্রায় পর্যটকশূন্য। অথচ গত এক মাস আগেও মুখরিত ছিল দেশি-বিদেশি পর্যটকে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ‘প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে পরের বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মৌলভীবাজারের প্রায় দেড় শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টাহাউস থাকত শতভাগ অগ্রিম বুকিং। চলতি বছরেও অগ্রিম বুকিং হয়েছিল।
তবে অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ থেকে অবরোধ-হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় ৯৫ শতাংশ বাতিল হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ায় চরম হতাশায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না হলে পর্যটনশিল্পে চরম বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করছেন তারা।’
শ্রীমঙ্গল হোটেল প্যারাডাইজের স্বত্বাধিকারী হাজী আবুজার বাবলা জানান, হরতাল ও অবরোধের কারনে ট্যুরিস্ট এই মৌসুমের তুলনায় ১০ ভাগ ও নাই। অথচ এখন নভেম্বর মাস পর্যটনের ভরা মৌসুম। প্রতি বছর এ সময়ে পর্যটন স্পটগুলোতে থাকত উপচে পড়া ভিড়। এখন ক্ষতির মুখে আমরা। এই ক্ষতি কিভাবে পুষাবো বুঝতে পারছি না। কর্মচারী ও বিদ্যুৎ বিল,ব্যাংকের লোন,বাসা বাড়া সব কিছু দিতে হিমসীম খেতে হচ্ছে। আমার মনে হয়না এভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবো। এভাবে যদি চলে তাহলে হোটেল রিসোর্ট গুটিয়ে নিতে হবে। আমরা দ্রুত দেশের এমন সংকটের সামাধান চাই।
কমলগঞ্জ অরণ্য বিলাস ইকো রিসোর্ট এর মালিক এহসান কবির সবুজ বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসার ধকল গেছে। করোনাভাইরাস, বন্যাসহ নানা কারণে পর্যটনশিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার আশায় ছিলাম, অতীতের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারব। কিন্তু দেশের যে পরিস্থিতি এ অবস্থায় পর্যটক বলতেই নাই। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারব কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি। এ অবস্থা চলমান থাকলে কর্মচারী ছাঁটাই করতে হবে সাথে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় ডাব বিক্রি করে সংসার চলে। এক মাস ধরে এ উদ্যানে কোনো ট্যুরিস্ট নাই। বেচা-বিকি নাই। দুরবস্থায় আছি। সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে।
কসমেটিক ও চা পাতা ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের কারনে পর্যটক নাই। সারা বছর আমরা অপেক্ষায় থাকি এই সময়ে পর্যটকের আনাগোনা বেশি থাকে।কিন্তু পর্যটক শূন্য থাকায় সংসার ও পরিবারের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।’
পর্যটন সেবা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের মালিক সেলিম আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুরো জেলার পর্যটন ব্যবসা ধ্বস নেমেছে। জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট রয়েছে। সবগুলোই এখন ফাঁকা। প্রতিদিন প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ছাঁটাই শুরু করেছে। অনেকের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই সমস্যা থাকে তাহলে ধ্বংসের মুখে পড়বে হোটেল রিসোর্ট’
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দায়িত্বরত ম্যানাজার শাহিন আহমেদ বলেন, ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেশি-বিদেশি পর্যটক বছরের এই সময়ে প্রতিদিন ৫০০-৭০০ ট্যুরিস্ট আসতেন, তখন টিকিট বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব আয় হত ৩৫-৪০ হাজার টাকা। এখন গড়ে ৮০-১২০ জন পর্যটক আসছেন সরকারের রাজস্ব আসছে ৩-৫ হাজার টাকা ’
লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান,‘এই মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটক দেখা যেত বর্তমানে হরতাল ও অবরোধের কারণে দেখা নাই। মানুষ নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে না, যানবাহন চলে না-তাই ভ্রমণে আসে না। প্রতি বছর যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো তা এখন হচ্ছে না।’
ট্যুরিস্ট পুলিশ মৌলভীবাজার জোনের উপ-পরিদর্শক প্রবাণ সিনহা বলেন, ‘নানা কারণে তুলনামূলকভাবে এবার পর্যটক অনেক কম। তবে ট্যুরিস্ট পুলিশ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে সোচ্চার। পর্যটকরা যাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সে লক্ষ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ সঞ্জয় চক্রবতী বলেন,‘দেশের সব উপজেলা থেকে আমার থানা এলাকায় অনেক পর্যটন স্পট। আমরা সবসময় ট্যুরিস্টদের সেবা প্রদান করে থাকি। কারো কোনো সমস্যা কখনো যেন না হয় সে খেয়াল আমাদের সবসময় থাকে। বর্তমানে বিএনপি-জামাতের দেওয়া হরতাল অবরোধের কারনে দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। সেই ক্ষতির অংশ হিসেবে পড়েছে পর্যটন শিল্পের উপড়ে। এই সময়ে হাজার হাজার পর্যটক দেখা যেত এখানে বর্তমানে নাই বললেই চলে। আমরা চাই এসব বন্ধ হউক। পর্যটন শিল্প রক্ষা হউক।’
এমবি