শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নূন্যতম মজুরি প্রত্যাখান করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে তৈরী পোশাক শ্রমিকরা। সকালে কিছু কারখানার শ্রমিকরা শান্তিপুর্ণভাবে ভিতরে প্রবেশ করেলেও কাজ বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করে আবার বের হয়ে যায়। এসময় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সড়কে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, ঢাকা জেলা পুলিশ ও বিজিবির পর্যাপ্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে আশুলিয়ার জামগড়া, বেরণ, ছয়তলা ও নরসিংহপুর এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের দলবেঁধে কারখানায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তবে এর আধাঘন্টা পরেই বেরণ এলাকার এ.এম ডিজাইন ও এনভয় গার্মেন্টস, সেতারা ও স্টারলিংক কারখানার শ্রমিকদেরকে কারখানা থেকে বের হয়ে যেতে দেখা যায়। এসব শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে আসলে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের উভয়পাশে অবস্থিত বেশকিছু কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
এ.এম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার অপারেটর লিটন বলেন, আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকেরা দিন-রাত কাজ করেও ঠিকমতো খাইতে পারি না। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না। নিত্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারনে প্রডাকশন টার্গেট পূরণ করতে যে পুষ্টি দরকার তার চাহিদাও আমরা পূরণ করতে পারি না। যে বেতন বাড়ানো হয়েছে সেটা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আমরা আন্দোলন করছি।
অপর শ্রমিক হাফিজুর বলেন, বেতন বাড়ানোর পরে আমার বেতন হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। দ্রব্য মূলের ঊর্ধ্বগতির কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি, এক কেজি পেয়াজের দাম ১২০ টাকা, আমরা খাব কি?। সরকার যেই আসুক আমাদের কোনো আপত্তি নেই। পেটের দায়ে আমরা এতো কষ্ট করি সাড়ে ১২ হাজার টাকায় আমাদের সংসার চলে না।
পুলিশ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিক অসস্তোষের মুখে বেশ কয়েকটি কারখানা বুধবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ আজকের জন্য ছুটি ঘোষণা করে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে। বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা কারখানার শ্রমিকেরা বৃহস্পতিবার সকালে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে বিভিন্ন অলিতে-গলিতে ঢুকে পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পোশাক শ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, নতুন ঘোষিত বেতনে অপারেটরদের কোনো লাভ হয়নি বরং বেতন কমে গেছে। ঘোষিত এই বেতন আমরা মানি না। ন্যায্য দাবি আদায়ে মাঠে নামলেই পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালাবে, এভাবে চলতে পারে না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, নতুন ঘোষিত মজুরি নিয়ে শ্রমিকেরা ধোঁয়াশায় থাকায় তাঁদের মধ্যে অসস্তোষ বিরাজ করছে। আজকেও বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জামগড়া থেকে জিরাব এলাকা পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ রয়েছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মজুরি বোর্ডের কাছে আইন অনুযায়ী ঘোষিত মজুরি রিভিউ করার আবেদন জানানো হবে।
এদিকে সকাল ১০ টার দিকে শিল্পাঞ্চলের নরসিংহপুর ও নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বিক্ষোভকারী শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এবিএম রশিদুল বারীসহ কয়েকজন পোশাক শ্রমিক ও আহত হয়েছেন।
সংঘর্ষে আহত হা-মীম গ্রুপের শ্রমিক আরিফুল বলেন, সকালে আমরা কারখানায় কাজ করছিলাম। পরে অন্য কারখানার শ্রমিকরা বাহিরে বিক্ষোভ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ছুটি দিয়ে দেয়। কিন্তু কারখানা থেকে বের হওয়ার পথে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ছোড়া ইট এসে আমার মাথায় লাগে। এসময় পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে বেশকয়েকজন শ্রমিক আহত হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, নরসিংহপুর এলাকায় হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা বিরাজ করায় শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বেশ কিছু কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে বিভিন্ন সড়কের পাশে অবস্থান করায় গোটা শিল্পাঞ্চলে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা গেছে। এর ফলে আশুলিয়ার কাঠগড়া, জিরাবো, আমতলাসহ আশপালের এলাকার অন্তত ৩০টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া শ্রমিক সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেয়। তবে দল বেঁধে যাওয়ার সময় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কিছু শ্রমিককে স্লোগান দিতে দেখা যায়।
অন্যদিকে সড়কে মোটরসাইকেল মোহড়া দিতে দেখা গেছে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম, ইয়ারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোশারফ হোসেনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের। পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে র্যাব, ঢাকা জেলা পুলিশ ও বিজিবির বিপুল সংখ্যক সদস্য। কিছুক্ষণ পরপরই টহল দিতে দেখা গেছে বিজিবির একাধিক সাজোয়া যানের।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, সকালে ৫-৬ টি কারখানার শ্রমিকরা বের হয়ে গেলে সড়কের পাশের অন্য কারখানাগুলোও ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শ্রমিকদের ছোড়া ইটে এসএসপি রশিদুল বারী আহত হয়েছেন। তিনি হাসপাতালে নিচ্ছেন। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রনে আছে।