For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

অবশেষে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন মুক্ত জীবনে

Published : Saturday, 3 September, 2022 at 2:11 PM Count : 471

দুজন কোনো দোষ করেননি। কিন্তু ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে ছিলেন কারাগারের কনডেম শেলে। সারাক্ষণ মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে কনডেম শেলেই কেটে গেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অবশেষে সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণ হয়েছে দুজন কোন দোষ করেননি। তাই তারা মুক্তি পেয়েছেন।

কিন্তু মুক্তির আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ধয়াপাড়া যৌবন লাইন গ্রামের ইসমাইল হোসেন ওরফে বাবু (৪২) ও মো. সোনারদি ওরফে সোনারুদ্দির (৬০) জীবনের ১৬টা বছর কেটে গেছে কারাগারে। এর মধ্যে ১৪ বছরই ছিলেন কনডেম সেলে। সম্প্রতি তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে জৈটাবটতলা মোড়। এখান থেকে কিলোখানেক পশ্চিমের গ্রামটি ধয়াপাড়া যৌবন লাইন। ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর এই গ্রামেরই সৌদি প্রবাসী বজলুর রহমানের স্ত্রী মিলিয়ারা খাতুন ওরফে রোকসানা ওরফে মিলু (৩০) এবং তার মেয়ে পারভীন ওরফে সাবনুরকে (৯) গলা কেটে হত্যা করা হয়। সেই মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলেন ইসমাইল ও সোনারদি। তারপর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ১৬টা বছর।

শনিবার সকালে বাড়ির সামনেই বসেছিলেন ইসমাইল। তিনি শোনালেন এ মামলায় ফেঁসে যাওয়ার গল্প। বললেন, মামলায় মোট আসামি ছিলেন চারজন। এরমধ্যে মুক্তার নামের একজন ঘটনার পর থেকেই পলাতক। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ তরিকুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেফতার করে। এই তরিকুলই ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁর পাশাপাশি ইসমাইল ও সোনারদি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
ইসমাইল জানান, তরিকুলের ভাগনিকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর একদিন তরিকুলের সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে সেদিন ইসমাইলও ছিলেন। এতটুকু ঘটনার কারণে তরিকুল তাঁদের দুজনকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। তরিকুল এ হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছিলেন। এ কারণে সবাইকেই ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। পরে আপিলে তরিকুলেরও দণ্ড কমে যাবজ্জীবন হয়েছে।

গ্রেফতরের পর শারীরীক ও মানসিক নির্যাতনের বর্ণনাও দেন ইসমাইল। জানান, গ্রেফতারের পর তাকে ও সোনারদিকে রিমান্ডে নেন তদন্ত কর্মকর্তা। দোষ স্বীকার করে নেয়ার জন্য নানারকম নির্যাতন করেন। এতো নির্যাতনের পরও তারা বলেছিলেন ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এরপর হাজতি হিসেবে তাদের জেলখানায় দুবছর কাটে। তারপর নিম্ন আদালত ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই রায় হয়। তরিকুলের জবানবন্দীর ভিত্তিতে তাদের সবাইকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরপর সোনারদি ও ইসমাইল উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ আপিল খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। এরপর তারা সুপ্রিম কোর্টে যান। এ বছরের ২৩ জুন সুপ্রিম কোর্ট তাদের খালাস দেন।

ইসমাইল বলেন, নিম্ন আদালতে যেদিন ফাঁসির রায় হয় সেদিনই তাঁদের কনডেম সেলে রাখা হয়। এরপর থেকে প্রতিটা দিন কেটেছে মৃত্যুর আতঙ্কে। রাতের পর রাত কেটে গেছে নির্ঘুম। আবার ঘুম গেলেই স্বপ্নে দেখতেন তোলা হচ্ছে ফাঁসির মঞ্চে। আবার কখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত কনডেম সেলের অন্য কয়েদিদের কান্নায়। হাউমাউ করে তাঁরা বলতেন, ‘আমি নির্দোষ। আমি কেন ফাঁসির আসামি!’ এভাবে কাঁদতেন ইসমাইলও।

তিনি জানান, কনডেম শেলে ৮ ফুট বাই ১০ ফুট শেলে একসাথে চার-পাঁচজন ফাঁসির আসামি থাকতেন। শেলের ভেতরেই কোমরসমান একটা দেয়াল দিয়ে টয়লেট। সেখান থেকে দুর্গন্ধ আসে অনবরত। এর ভেতরেই আসামিদের থাকতে হয়। গুমোট-স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। শেলের কোন জানালা নেই। সামনের দিকের লোহার ফটকটিই জানালা। সকালে কিছু সময়ের জন্য এটি খোলা হতো। বাইরে বেরিয়ে গোসল সেরে সবাই প্রয়োজনীয় পানি তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতেন। দুপুরে খাবার নেয়ার জন্য কিছু সময় বাইরে আসার সুযোগ। এরপর আবার ভেতরে। বিকালেও রাতের খাবার নেয়ার জন্য একটু বের করা হতো। খাবার নেয়া শেষেই আবার ওই শেলে। পরদিন সকাল থেকে আবার একই রুটিন।

কনডেম সেলের কষ্টের দিনগুলোর কথা বলতে বলতে আবার চোখের কোণে পানি চলে আসে ইসমাইলের। বলছিলেন, সকালে একটা রুটি, এক টুকরো গুড়। দুপুরে ভাত আর ডাল। রাতে ভাত, সবজি আর এক টুকরো মাছ। এই খাবারই খেয়ে কেটেছে কারাগারের লম্বা সময়। শেষ কয়েকবছর খাবারের মানের একটু উন্নতি হয়েছে। তিনি জানান, বিশেষ দিবসগুলোতে বাড়ি থেকে খাবার দেয়া যায়। এক ফাঁসির আসামিকে বাড়ি থেকে দিয়েছিল ছাতু। সবাই মিলে তা খাওয়ার সময় দেখে ফেলেন জমার্দ্দার। তাঁর কথা, কারাগারে ছাতু আসা নিষেধ। এলো কীভাবে? এ নিয়ে তর্ক। শাস্তি হিসেবে ইসমাইলকে সাতদিন পরিয়ে রাখা হলো ডান্ডাবেড়ি। এমন শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। এখন শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ-বিসুখ। দুই দিন আগেও ডাক্তার দেখিয়েছেন।

ইসমাইলের বাড়ির সামান্য দূরে সোনারদির বাড়ি। শনিবার সকালে বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল না। কথার ঝাঁপি খুললেন তাঁর স্ত্রী জুলেখা বেগম। বললেন, তারাবির নামাজের সময় খুনের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় বাড়িতেই শুয়ে ছিলেন সোনারদি। তাও তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর স্বামীকে কয়েকদিন পর গ্রেফতার করেছিলেন। তারপর চাতালে কাজ করে জুলেখা তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে বড় করেছেন। মামলা চালাতে গিয়ে নিঃশ্ব হয়েছেন।

বাড়ি ফিরে সোনারদিও শোনালেন তাঁর জেলজীবনের কষ্টের কথা। বললেন, তদন্ত কর্মকর্তা তরিকুলকে বলেছিলেন, অন্য কারও নাম বললে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন তরিকুল তাঁদের ফাঁসিয়েছিল। এরপর তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। রিমান্ডের সাতদিনের নির্যাতনের সে ব্যাথা এখনও কাটেনি। আর কনডেম শেলে প্রতিটা দিনই কেটেছে মৃত্যুর আতঙ্কে। এই মনে হয়েছে আজ ফাঁসি দিয়ে দিবে, শুধু হুকুমের অপেক্ষা।

ইসমাইল ও সোনারদি জানিয়েছেন, মা-মেয়েকে খুনের ঘটনার পর এলাকার কয়েকজন পালিয়ে ছিলেন। চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর তারা এলাকায় ফেরেন। যাঁরা পালিয়ে ছিলেন, তাঁরাই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে তাঁরা মনে করেন। কিন্তু এখন আর তাঁরা বেঁচে নেই। শুনেছেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও মারা গেছেন। তাই এখন আর তাঁরা কারও বিচার চান না। জুলেখা বললেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা আসল খুনিদের টাকা খেয়ে নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসিয়েছিল। তাই বিচার আল্লাহকেই দিয়েছি।

আর ইসমাইল বললেন, জেলখানায় আমার মতো অনেক নির্দোষ ব্যক্তি দণ্ড মাথায় নিয়ে দিন গুণছে। আমরা যদি এখন নির্দোষ হয়ে কারও বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে যাই, তাহলে বিচারব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়বে। সবাই ভাববে, জেল থেকে বেরিয়েই এরা ঝামেলা করছে। এটা উদাহরণ হিসেবে দেখা হবে। তখন যেসব নির্দোষ ব্যক্তি জেলে, তাঁরা আর বের হতে পারবে না। তাই আমরা কোনো ঝামেলা করতে চাই না। সব ভুলে যেতে চাই। কিন্তু জীবনের ১৬টা বছরের এতো কষ্টের কথা তো আর ভুলে যাওয়া যাবে না।

আরএইচ/এনএন

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,