For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

প্রাকৃতিক দুর্যোগে কুকরি মুকরিবাসীর সুরক্ষা ম্যানগ্রোভ বন

Published : Monday, 13 September, 2021 at 12:15 PM Count : 689

ভোলাচরফ্যাশনের চর কুকরি মুকরির যেখানে দৃষ্টি পড়ে, যতদূর চোখ যায়, দিগন্ত বিস্তৃত অবিরাম সবুজ আর সবুজ। এটি গাছের ঘন গুচ্ছ, যার তিন পাশে নদী এবং চতুর্থ দিকে সমুদ্র। সমুদ্রের মুখে দাঁড়িয়ে ম্যানগ্রোভ বন একটি বিশাল প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবে কাজ করে যা দ্বীপটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে, যেমন একজন পিতা-মাতা একটি শিশুকে শারীরিক বিপদ থেকে রক্ষা করেন। 

চর কুকরি মুকরির মানুষের জন্য, ম্যানগ্রোভ কোন ত্রাণকর্তার থেকে কম নয়। চর কুকরি মুকরি, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা সাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা চরফাশন উপজেলার একটি দ্বীপ ইউনিয়ন।

এই দ্বীপে মানুষের বসতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ১৫০ বছর আগে। ১৯৭০ সালে এলাকায় ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব ছিল না। যখন একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় (ভোলা ঘূর্ণিঝড়) এই পতিত অঞ্চলে আঘাত হানে, তখন এটিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে, পুরো দ্বীপটি ধুয়ে দেয় এবং দেশব্যাপী আনুমানিক তিন-পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে।

ঘূর্ণিঝড়ের পর যারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বসবাস করে তারা ম্যানগ্রোভ বনকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে মনে করতে শুরু করে। তাই ১৯৭২ সালে কুকরী মুকুরী চরে বন সম্প্রসারণ অধিদফতরকে বনায়ন করার নিদের্শ দিলে ১৯৭৩ সালে বনায়ন শুরু হয়।
এখন গোটা এলাকা জুড়েই চোখে পড়ে বিপুল সংখ্যক কেওড়া গাছ। মূলত বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা এসব গাছ আর আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। 

বন বিভাগ ও বিভিন্ন সূত্রে জানায়, ভাঙা গড়ার আবর্তে পড়ে বর্তমান কুকরী-মুকরী চরে বনায়নের পরিমাণ প্রায় সাত হাজার হেক্টর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বাগান নয় হাজার চারশ’ একর। ছয় ধারায় প্রস্তাবিত ছয় হাজার হেক্টর, বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ২১৭ হেক্টর। 

এখন সেই মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা স্মরণ করিয়ে দেন- যদি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়রের সময় এই ম্যানগ্রোভ বন থাকত, তাহলে আমরা আত্মীয়-স্বজন হারাতাম না। আমরা সম্পদ হারাতাম না।৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে, দ্বীপটি ঘূর্ণিঝড় থেকে পাওয়া ধ্বংসাত্মক পাঠের ভিত্তিতে একটি নতুন পরিচয় তৈরি করেছে। এটি এখন নদী ভাঙ্গণ এবং জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। মানুষ এখন বাড়ি তৈরি করতে দ্বীপে চলে আসে। বর্তমানে চরে বসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় চার হাজার ৮১০ হেক্টরে। চরের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও কৃষি কাজ।

চর মাইনকা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদের মাল ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরও বেঁচে আছেন। তার বয়স এখন ৯০ ছুঁইছুঁই। তিনি বেঁচে থাকার সময় তার স্ত্রী, সন্তান ও সমস্ত আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়েছিলেন। দক্ষিণ দিক থেকে আসা পানির তোড়ে সব কিছু ধুয়ে গেছে। কুকরি মুকরি ম্যানগ্রোভ এখন আমাদের রক্ষা করে।

তিনি বলেন, এই ম্যানগ্রোভ গাছপালা না থাকলে আমাদের অনেকবার পানিতে ভাসতে হতো। 

তার গ্রামের অন্যরাও একই অনুভূতির প্রকাশ করেছেন। 

মফিদুল ইসলাম নামের একজন বলেন, যদি আমাদের আগে এই ম্যানগ্রোভ থাকত, তাহলে আমরা কিছু হারাতাম না। কী কারণে ঘূর্ণিঝড়টি এত ক্ষতির কারণ হয়েছিল? গ্রামবাসীরা বলছেন যে এখানে বাঁধ ছিল না এবং গাছের অভাবে মানুষের ঘর-বাড়ি অরক্ষিত ছিল। যেমন- উচ্চ জোয়ার সবকিছু ধুয়ে ফেলে। কিন্তু এখন ম্যানগ্রোভের জন্য ধন্যবাদ, গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার অনুভূতি রয়েছে। 

চর মাইনকার আরেক বাসিন্দা আব্দুল রশিদ রাড়ি বলেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ বন লাগানো হয়েছিল। ৫০ বছরে, সেই গাছগুলো অনেক বেড়েছে। এই ম্যানগ্রোভগুলো এখন আমাদের ঢাল। আমরা বনের কারণে ঝড় অনুভব করি না।

বন বিভাগের চর কুকরি মুকরি রেঞ্জ অফিসের সাইফুল ইসলাম বলেন, সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ের পর সরকারের বন বিভাগ এই ম্যানগ্রোভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ৮০ এর দশকে চর কুকরি মুকরি রেঞ্জ ম্যানগ্রোভের ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল স্কেল-আপ বনায়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে। প্রাকৃতিক বন এলাকার বাইরে বন বিভাগ কুকরি মুকরি দ্বীপের চারপাশে নির্মিত বেড়িবাঁধের দুই পাশে গাছ লাগিয়েছে। এখন কয়েক দশক পরে সমগ্র দ্বীপটি সবুজতায় ভরা, ধীর বর্ধনশীল ম্যানগ্রোভ যার পরিমাপ প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর। বন বিভাগ এবং স্থানীয় দ্বীপবাসীদের মধ্যে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা যৌথ।

তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা কুকরি মুকরির ১৪ হাজার জনসংখ্যা স্থানীয় ভাবে ম্যানগ্রোভ বনগুলোকে সক্রিয় ভাবে রক্ষা করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিযেেছ। 

কুকরি মুকরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, বনের গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেকোনো কার্যকলাপ যা বনের ক্ষতি করে তা এখানে নিষিদ্ধ। বনের খালে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা রযেেছ। আমরা পাখিদের বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং অতিথি পাখিদের অবাধে ঘোরাঘুরির সুযোগ দিচ্ছি।  

২০০৯ সালে থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কুকরি মুকরি ম্যানগ্রোভে এবং তার আশপাশে টেকসই বনায়নের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। 

ইউএনডিপির আইসিবিএএআর প্রকল্পের যোগাযোগ কর্মকর্তা কবির হোসেন বলেন, আমরা বন ব্যবস্থাপনায় টেকসই ম্যানগ্রোভ নির্মাণ কৌশল প্রয়োগ করেছি। আমরা ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছি। ফলস্বরূপ, স্থানীয়রা ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ করছে নিজেদের প্রয়োজনে। স্থানীয় সম্পৃক্ততার একটি উদাহরণ হলো কুকরি মুকরি সবুজ সংরক্ষণ উদ্যোগ। 

তিনি বলেন, স্থানীয় যুবকদের একটি দল দ্বারা গঠিত এই উদ্যোগ ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির নেতৃত্ব দেয়। উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচারণায় স্বেচ্ছাসেবী এবং ইকো-ট্যুরিজম প্রচেষ্টায় অংশ নেওয়া। যদি এই ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকে, তাহলে আমরা বাঁচব। আমাদের ম্যানগ্রোভকে আমাদের জীবনের প্রয়োজনে রক্ষা করতে হবে।

কেএমজিসিআই'র সমন্বয়কারী জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এত মানুষ মারা যাওয়ার কারণ সেখানে কোন ম্যানগ্রোভ ছিল না। আমরা আর কখনও সেই দৃশ্য দেখতে চাই না। এ জন্যই আমরা তরুণদের উদ্যোগে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণে কাজ করছি। এরই মধ্যে আমরা ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। কুকরি মুকরি ছাড়াও, চার বছরের ইউএনডিপি প্রকল্পটি বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলে বাস্তবায়িত হয়েছিল।

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,