বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে আশা দেখাচ্ছে তৈল ফসল গোল্ডেন পেরিলা। এর অন্য নাম ‘সাউ পেরিলা-১। এবছর জেলার গোদাগাড়ীতে পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে এটি। স্থানীয় কৃষি দফতর বলছে, পরীক্ষামূলক গোল্ডেন পেরিলা চাষে সফলতা এসেছে। এখন বরেন্দ্রজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হবে উচ্চ মূল্যের এই ফসল।
পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ করেন গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর মহল্লার বাসিন্দা শাহাদাত হোসাইন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শাহাদাত হোসাইন জানিয়েছেন, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি উপজেলায় পেরিলার গবেষণা প্লটের বিষয়ে জানতে পারেন। যোগাযোগ করার পর তিনি সেই সুযোগ পেয়েও যান। পরে পেরিলা বীজ, সার ও কীটনাশকসহ সব ধরণের সহায়তা দিয়েছে কৃষি দফতর।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান। দেশের ১৪টি অঞ্চলে একযোগে পেরিলার গবেষণা প্লট ছিলো। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতেও পরীক্ষামূলক পেরিলা চাষ হয়।
উপজেলার দেওপাড়া এবং গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর এলাকায় দুটি প্রদর্শনী প্লট ছিলো পেরিলার। নতুন ফসল হিসেবে কিছু পেরিলা চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। পেরিলার চারা আগস্টে জমিতে রোপন করতে হয়। কিন্তু গোদাগাড়ীতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রোপন করা হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তোলা হয় ফসল।
স্থানীয় সরিষা ভাঙানোর মেশিনে পেরিলার বীজ ভাঙানো হয়েছে। প্রতি কেজি পেরিলায় পাওয়া গেছে ৪০০ গ্রামের মত তেল। বাজারে প্রতি লিটার পেরিলার তেল ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগামীতে পেরিলা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি বলেন, আমরা সব তেল ফসলের প্রদর্শনী প্লট করি, এর আওতায় কিভাবে পেরিলা আনা যায়? সেটি চিন্তাভাবনা চলছে।
তিনি সাত কাঠা জমিতে পেরিলা চাষ করেন এবার। তা থেকে বীজ পেয়েছিলেন ৯ কেজি। ভাঙিয়ে তেল হয়েছে এক লিটার ৮০০ গ্রাম। পুরোটাই তেল উপজেলা কৃষি দফতর সংগ্রহ করেছে।
শাহাদাত হোসাইন আরো জানান, তার পেরিলা চাষ দেখে স্থানীয় কৃষকরা অনুপ্রানীত হয়েছেন। চাষের আগ্রহ নিয়ে অনেকেই তার সাথে যেগাযোগও করেছেন। এখনো অনেকে যোগাযোগ করছেন। তিনিও আগামীকে বড় পরিসরে পেরিলা চাষ করবেন।
পেরিলা চাষে তেমন বাড়তি যত্ন নেয়ার প্রয়োজন নেই জানিয়ে তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা জানান, তিনি বীজ তলায় বীজ বপন করেন। এর এক মাসের মাথায় চারা তৈরী হয়। এরপর জমি তৈরী করে সাধারণত মরিচ কিংবা বেগুন চারা রোপনের মত করে সারিবদ্ধ করে পেরিলা চারা রোপন করেন।
শুধু শুয়োপোকা পেরিলার পাতা খেয়ে ফেলছিলো। তাছাড়া কিছু গাছে ছত্রাকের আক্রমণে কা- পচে যায়। এই দুই বালাই নিয়ন্ত্রণে তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এরপর আর আক্রমণ আর হয়নি।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, পেরিলার বৈজ্ঞানিক নাম Perilla frutescens। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে পেরিলার চাষ হয়। বাংলাদেশে যে পেরিলার চাষের জন্য অভিযোজিত হয়েছে কোরিয়ান পেরিলা।
সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় বীজ বোর্ড ‘সাউ পেরিলা-১ নামে পেরিলার নতুন জাতটির নিবন্ধন পায়। পেরিলার এই জাতটি সারা দেশে উৎপাদনক্ষম। জুলাই এর মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পেরিলা চাষ উপযোগী। হেক্টর প্রতি প্রায় দেড় টন এর ফলন পাওয়া যায়।
পেরিলা একটি ভোজ্যতেল ফসল যার শতকরা ৬৫ ভাগই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। পেরিলার তেল বিশেষত হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।
এর আগে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচ এম এম তারিক হোসাইনের অধীনে পেরিলা নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম মজুমদার।
তিনি বলেন, মূল জমিতে পেরিলার জীবনকাল ৭০ থেকে ৭৫ দিন। এটি সহজেই চার ফসলি জমিতে চাষের আওতায় আনা সম্ভব। পেরিলার প্রতিটি পুষ্পমঞ্জুরিতে ১০০ থেকে ১৫০টি বীজ পাওয়া যায়। ফলে অন্য তেল ফসল থেকে এর উৎপাদনমাত্রা অনেকাংশে বেশি।
গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. এইচএম তারিক হোসাইন বলেন, মুলত: চীন, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে পেরিলার বহুল প্রচলন রয়েছে। চাইনিজ, কোরিয়ান ও থাই রেস্টুরেন্টগুলো সবজি হিসেবে পেরিলার পাতা ব্যবহার করে। দেশীয় এমন রেস্টুরেন্টগুলো বিদেশ থেকে পেরিলার পাতা আমদানি করে।
পেরিলার বীজ থেকে যে তেল উৎপাদন হয় তা অত্যন্ত উচ্চ মূল্যের। পেরিলার ফুলে প্রচুর মৌমাছি সে। ফলে বাণিজ্যিক মধু চাষেও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে পেরিলা।
আরএইচ/এইচএস