সামাজিক অসম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দীর্ঘকাল ধরে আত্মীয় স্বজনহীন, বন্ধুবিহীন, অস্পৃশ্য জীবনের এক ভয়াবহ শাস্তি মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে রংপুরসহ দেশের প্রায় ১১ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের। জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ।
নাম পরিচয় যাই থাকুক না কেন ডাকে ‘হিজড়া; আবার কেউ ডাকে ‘ছক্কা’ বলে। নেই তাদের যথাযথ আবাসন, কর্মক্ষেত্র। অথচ পরিবারের সযত্নে এই মানুষেরা সমাজের বোঝা না হয়ে হতে পারেন একেকজন সাবলম্বী মানুষ। কিন্তু সামাজিক হীনমন্যতায় পরিবারে এদের জায়গা হয়না। এমনই অভিযোগ রংপুরের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর।
গত ২৫ জানুয়ারি ভাইদের সহিংসতার স্বীকার হন শহীদ হোসেন ওরফে শ্রাবন। হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে মেলামেশা করলে কিংবা হিজড়া পরিচয় দিলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন বলে শাসিয়েছেন ভাইয়েরা। শুধু তাই নয় বাসায় ঢুকতে নিষেধ করা স্বত্বেও বাসায় ঢুকতে গেলে ভাইয়েরা নির্মমভাবে হামলা চালায় শ্রাবণের উপর।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নং ওয়ার্ডে অর্থ সার্জারি বিভাগে চিকিৎসারত শ্রাবণ বলেন, "আমাকে সম্পত্তি থেকে বিচ্যুত করার জন্য আমার ভাই ও চাচা জোগসাজস করে আমার উপর হামলা চালিয়েছে। বাবা মা বেঁচে থাকতে তারা কখনোই চাইনি আমি হিজড়াদের সাথে বের হয়ে যাই। কিন্তু আমার ভাইরা চায়না আমি পরিবারে থাকি। পরিবারে থাকলে নাকি সমাজ তাদের কবর দিতে আসবে না।
তাদের ছেলে মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না। আমি হিজরা বলে নাকি তাদের সমাজে নানা কথা শুনতে হয়। শুধু আমি নই এভাবেই যুগের পর যুগ থেকে হিজড়াদের সাথে অমানবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। আমি হিজড়া হলেও আমি মানুষ। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আমার আছে। তাই আমি এর সঠিক বিচার চাই।
শ্রাবনের ছোটভাই সজীব বলেন, "তাকে মারধর করা হয়নি শুধু বলা হয়েছে ও পথ থেকে ফিরে আসতে। ওতো আমাদের ভাই আমরা জানি ও হিজড়া নয়। টাকা দিয়ে হয়তো ওরকম সার্টিফিকেট বানিয়েছে। ওর যদি ওরকম সমস্যা হতো তাহলে তো আমাদের সাথে শেয়ার করতো। তার জন্য আমাদের বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ আসে এবং আমাদের বলে, তোমার ভাই হিজড়া। ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগে। ওকে ভালো করার জন্যই এত কিছু করা। ও যদি ওই পরিবেশে থাকে তাহলেও চলে যাক। আমাদের তো পরিবেশ আছে।"
সজীব মারধরের কথা স্বীকার না করলেও ঘটনা সত্যতার কথা স্বীকার করেছে শ্রাবণের চাচা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, " ওরা ভাইয়েরা ভাইয়েরা মারামারি করেছ। আমি কাউন্সিলের অফিস থেকে এসে দেখি শ্রাবণ আমার দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে পুলিশ প্রশাসন এসেছে। ডেকে ওকে মেডিকেলে পাঠিয়ে দেই। এখন যদি আমার দোষ হয় আমার কিছু করার নেই
শ্রাবণের বড় ফুফু তপিরুন্নেছা বলেন, "আমার ভাই বেঁচে থাকাকালীন সময়ে কখনোই চাইনি ও হিজড়াদের সাথে চলে যাক। ভাই মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর সাথে অমানবিক অত্যাচার শুরু করেছে আমার ভাই ভাতিজারা। এখন ওর ঘরটা কেড়ে নিতে চায়। এজন্য ওকে ধরে মারধর করেছে। ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া উচিত।
মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট মুনির চৌধুরী বলেন, "মানবাধিকারে বলা হচ্ছে সব মানুষ সমান। সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে হিজড়া, শিশু, বয়স্ক, শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা নগরে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষই সমান।
সমান বলেই সবাই আইনের সমান অধিকার লাভ করবে। হিজড়াদের মধ্যে জন্মগতভাবেই নারী পুরুষের সংমিশ্রণ দেখা যায়। তাদের দৈহিক গঠনে নারী ও পুরুষের মিশ্র অঙ্গাঙ্গী গঠন দেখা যায়। যেটা দেখতে অনেকটা অস্বাভাবিক মনে হয়। Universal declaration of human rights অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার লাভ করবে। আমাদের সংবিধানও সেটি আত্মস্থ করেছে।
আমাদের সংবিধানে ২০১৪ সালে হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করা হয়েছে এবং এবং সকল কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে বলা হয়েছে। এই যে শ্রাবণ, যাকে হিজড়া হওয়ার কারণে পরিবার থেকে নিগৃহীত করা হয়েছে এবং আহত করা হয়েছে তারা কিন্তু মূলত অপরাধ করেছে। দেশের প্রচলিত যে দ্বন্দ্ববিধি সেই দণ্ডবিধিতেই তাদের বিচার করা খুবই স্বাভাবিক।
রংপুরের ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোট বেলায় আর দশটা শিশুর মতো তাদের কপালে আদর জুটলেও বড় হয়ে জোটে তিরস্কার, গঞ্জনা আর শাস্তি। ছোটবেলায় আঙ্গিক বৈসাদৃশ্য থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন তারা। সময়ের সাথে তাদের আচরণগত বৈসাদৃশ্য মেনে নিতে পারেন না বাবা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। অবশেষে বাড়ি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। মায়ের প্রচন্ড ভালবাসা পেলেও অধিকাংশ বাবাই যেন ভয়াবহ মুর্তি। মেনে নিতে পারেন না সন্তানের এমন আচরণ। রংপুরের নুরপুরের একটি তিন রুম বিশিষ্ট চালাঘরে বাস করছেন ৪৭ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্য আসমা বলেন, শুরু থেকে সবকিছু ঠিক ছিল। বাবা মা ভাই বোন একসাথেই থাকতাম। আমার বাবা-মা আমাকে খুবই ভালোবাসতো। মা আমাকে খুবই সাপোর্ট করতো এবং কখনোই চাইতো না অন্যান্য হিজড়াদের মত আমি রাস্তায় ভিক্ষা করি। আমি হস্তশিল্প ও গবাদি পশু পালন এক কথায় বাড়ির সমস্ত কাজ আমি করতে পারি। এসব করে আমি প্রায় নয় লাখ টাকার মত জমিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে জমি বন্ধক নিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমার ভাইয়েরা সেই টাকা তুলে আমাকে না বলেই ভাগাভাগি করে নিয়েছে। যখন দেখেছে আমি অনেক উন্নতি করছি তখন আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং সম্পত্তির অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। এরপর বাড়িতে যতবার গিয়েছি আমার কপালে শুধু মার টুকুই জুটেছে।
আসমা আর বলেন, সরকার আমাদের হিজড়া পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু সমাজ আমাদের ভালো চোখে দেখেনা। সমাজে সব সময় আমরা হেয় হয়ে থাকি। আমার ভাইয়েরা বাবা মাকে দেখে না। আমি ভিক্ষাবৃত্তি করে আমার বাবা মাকে দেখছি।
হিজড়া সম্প্রদায়ের আরেক সদস্য সাথী বলেন, পাড়ার লোকেরা আমাদের খারাপ চোখে দেখেন তাই বিরক্ত হয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছি। এখন আমরা আমাদের নেতার কাছে চলে এসেছি। তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, কর্মসংস্থান দিয়েছে তাই তারই কাছে থাকি।
এনিয়ে রংপুর সুজন মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জুর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ’প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। এছাড়াও প্রত্যেক সম্প্রদায়ের অধিকার সমান। আল্লাহ পাক আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষকে বিবেচনা করেছেন। কে কোন পর্যায়ে, কোন গোত্রে, কোন বর্ণের সেটা নির্ধারণ করবেন আল্লাহ পাক। সমাজে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার তার আছে। গত নির্বাচনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখেছি হিজড়ে সম্প্রদায়ের কয়েকজন সদস্য নির্বাচনী স্ব স্ব স্থানে লড়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, " কর্মের জায়গায় যদি বলি, বৈশাখী টেলিভিশনের একজন খবর পাঠ করেন। এছাড়া ঢাকায় একটি বিউটি পার্লারেও একজন হিজড়া ভালো কাজ করছেন। এছাড়াও হিজড়ারা পড়াশোনা করছে। রংপুর কারমাইকেল কলেজে এখনো অনেকে পড়াশোনা করছে এবং গ্রাজুয়েশন করেছেন। এছাড়া আমরা মনে করি তাদের একটা দায়িত্ব আছে। এদের ভিতর মেধা আছে, সৃজনশীলতা রয়েছে। সুতরাং বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বিরক্ত করে ভিক্ষা করার চেয়ে সরকারের উচিত এদের পুনর্বাসন করা। যেহেতু সরকার এদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে ও ভোটাধিকারের অধিকার দিয়েছে। সরকার নানাবিধ সামাজিক কর্মকান্ড হাতে নিয়েছে, নানাবিধ কর্মসংস্থান তৈরি করছে। এছাড়াও স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করার লক্ষ্যে এদেরকে প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়।’
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, "এসডিজির যে গোল অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা, সেগুলো খেয়ে দেশের পিছিয়ে পড়ে জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে নিয়ে আসাই সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তথা সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজরা জনগোষ্ঠী নিয়ে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের জরিপমতে সারা বাংলাদেশে ১১ হাজার হিজড়া রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার হিজড়াকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে হিজড়া জনগোষ্ঠী দেখলেই তাদেরকে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। এবং তাদেরকে পরিবার বিচ্যুত হতে বাধ্য করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থ বছর থেকে আমরা চেষ্টা করছি হিজড়াদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার। দেশের ১১ হাজার জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে নিয়ে আসলে আমরা অনেকটা সক্ষম হয়েছি।
জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা এই কাজটি করে যাচ্ছি। আমরা সেই পরিবারগুলোকে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছি যে এটা পরিবারের বাইরের অংশ নয় এটা পরিবারেরই অংশ। আমরা বোঝাচ্ছি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হোক কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হোক যে পরিবারে এরকম শিশু জন্ম হচ্ছে এটা কোন পাপ নয়। ফলে অনেক পরিবার এই বুঝতে পেরেছে, আমরা হিজড়াদের পরিবারের সাথে একীভূত করার চেষ্টা করছি। আর ইতোমধ্যেই যারা সমাজচ্যুত কিংবা পরিবার বিচ্যুত হয়েছে তাদের আমরা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ট্রেডের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি।
এছাড়াও কোথাও যদি বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তাদেরকে আমরা জেলা লিগ্যাল এর মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি সেবা প্রদান করছি। "
এলইয়/এমবি