তামাক। যে গাছের পাতাই ফসল। এর আবাদ যেমন ফসলি জমির মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে তেমনই এর সংস্পর্শে থাকা কৃষকেরও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির। অথচ সেই বিষাক্ত তামাক চাষ করছেন পরিবারের সবাই মিলে। কৃষক তার স্ত্রী-সন্তান-ভাই-ভাতিজাকে নিয়ে তামাকে ক্ষেত পরিচর্যা করছেন। সরেজমিনে লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়নের মুসর দৌলজোর গ্রামের কৃষক নূর ইসলাম। দুই বিঘা ফসলি জমির পুরোটাই তিনি করেছেন তামাকের চাষ। রোপা আমন কেটে জমি চাষ করে এক মাস হলো রোপণ করেছেন তামাকের চারা। সেই চারাগাছে পানি দিচ্ছেন তার মা রাবেয়া (৬২), ভাতিজা আলাউদ্দিন (১৪)। এমনকি তার আট বছরের কন্যা তামান্নাও ব্যস্ত সেই তামাকের জমিতে পানি দেয়ায়।
তামান্নার সঙ্গে কাজের ফাঁকে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সে জানায়, পার্শ্ববর্তী একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে সে। এখন ডিসেম্বর মাস বলে স্কুলে যেতে হয় না। স্কুল বন্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাবার ফসলি ক্ষেতে কাজ করতে এসেছে। সকাল ৮টায় এসে একবার চারাগাছে পানি দিয়ে খেয়ে এসেছে। আবার ১০টা থেকে একনাগাড়ে পানি দিয়ে চলেছে। জমির অপর প্রান্তে আগাছা নিড়ানি দিচ্ছেন তামান্নার দাদি রাবেয়া ও চাচাতো ভাই আলাউদ্দিন। দুপুরে তামান্না বাড়ি চলে গেলেও পরিবারের বাকি সদস্যরা কাজ করবে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
নূর ইসলাম বলেন, 'তামাক কোম্পানির প্রণোদনার সার, বীজ, কীটনাশকে এর আবাদ করা তার জন্য সহজ হয়েছে। প্রতি বছর এই সময়টায় পরিবারের সবাই সারা দিন ব্যস্ত থাকেন তামাকের জমি পরিচর্যায়। আবার তামাক পাতা শুকানোর পর বিক্রির জন্য বেগও পেতে হয় না। কেননা যে কোম্পানি তাকে প্রণোদনা দিয়েছে সেই কোম্পানিই তার উৎপাদিত তামাক নির্ধারিত দামে কিনে নেয়।'
তামাকের আবাদে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে জেনেও কেনো তা আবাদ করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'অন্য ফসলে যে লাভ তামাক বিক্রি করে তার চেয়ে বেশী পাই। তাই বেশি মুনাফার আশায় প্রতি বছর তামাক চাষ করি।'
নূর ইসলামের তামাক ক্ষেতের পাশেই আরেক কৃষক জয়নালের ফসলি জমি। তার ৪৫ শতাংশ জমিতেও চাষ করছেন তামাক। নূর ইসলাম ও তার স্ত্রী জুলেখা বেগম (৩২) দু'জনেই ব্যস্ত তামাকের জমিতে পানি দিতে।
জয়নাল বলেন, 'এখনও তামাকের চারাগুলো ছোট। তাই শুধু চারার সারি লাঙল দিয়ে টেনে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে চলছে পানি দেয়ার কাজ। চারাগাছ বড় হলে পুরাতন পাতা ছিঁড়ে দেয়া, আগাছা নিড়ানো- এসব কাজ করতে হবে।
তখন তো তামাকের গাছ থেকে বিকট গন্ধ বের হবে, কাজ করবেন কিভাবে; অসুস্থ হন না? উত্তরে তিনি বলেন, 'তখন খুব বেশী কষ্ট হয় না; সমস্যা হয় যখন তামাকের পূর্ণবয়স্ক পাতা শুকাতে দেই। সে সময়ে এর আশেপাশে যাওয়া যায় না, গন্ধ বহুদূর থেকেও পাওয়া যায়। আর অসুস্থ হলেও এত চিন্তা করে কি হবে, কৃষক মানুষ আবাদ তো করতেই হবে।'
তাদের মত আরও অনেকে বলেন, জেলায় অন্তত সাতটি তামাক ক্রয়ের কোম্পানি আছে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো কৃষকদের বিভিন্ন ভাবে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এই কোম্পানিগুলোর এলাকাভিত্তিক নিজস্ব তামাক চাষিদের তালিকা আছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি কোম্পানির আলাদা ভাবে তালিকা থাকে। সেই তালিকা ধরে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে বীজ, ঋণ হিসেবে বাজার দরে সার, কীটনাশক (যা তামাক ক্রয়ের পরে মূল্যের সঙ্গে পরবর্তীতে সমন্বয় করা হয়) এবং নগদ টাকাও ঋণ দেয়। ফলে তামাক চাষের বেড়াজাল থেকে কৃষকরা বের হতে পারেন না। বেশি লাভের আশায় জেলার শত শত তামাক চাষি পরিবারের সবাই মিলে তামাক চাষ করছেন।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো সদর ও আদিতমারী উপজেলায় প্রায় ১২০০ একর জমিতে তামাক চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তামাক চাষে জমির উর্বরতা নষ্ট হলেও কিংবা স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলেও কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে দিনের পর দিন তামাকের চাষ বেড়েই চলেছে। রবিশস্যের বদলে চাষিরা ঝুঁকছেন তামাক চাষের প্রতি। বিনামূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফা লাভের আশায় তামাকের ক্ষেতে কাজ করছেন নারী ও শিশুরাও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক (অবসরপ্রাপ্ত) উপপরিচালক বিধূভূষণ রায় বলেন, 'তামাক চাষে যে কৃষকের সামর্থ্য থাকে তারা শ্রমিক ভাড়া করে। কিন্তু অধিকাংশ চাষির এ সামর্থ্য থাকে না। ফলে তামাক পাতা উঠানোর মৌসুমে বাড়ির নারী, পুরুষ, শিশু সকলকে একসঙ্গে মাঠে কাজ করতে হয়। এ সময় শিশুরা স্কুল কামাই করে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে মাঠে কাজ করে। ফলে তামাক চাষিদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে তাদের শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষ থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত সময়কালে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপস্থিতির হার কমে যায়। শিক্ষাজীবনে সমস্যার পাশাপাশি শিশুরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বিনামূল্যে শ্রম প্রাপ্তির লক্ষ্যে তামাক চাষি তার পরিবারের সদস্যদের তামাক চাষ থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত সকল কাজে সম্পৃক্ত করেন। ফলে পারিবারিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটে।'
তিনি আরও বলেন, 'জমি কৃষকের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। প্রচুর রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার তামাক চাষের একটি বড় ক্ষতিকর দিক। নানাবিধ কারণে বিগত বছরগুলোতে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। এ রাসায়নিক ও কীটনাশক মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানি ধারণক্ষমতা নষ্ট এবং ক্ষয় বৃদ্ধি করছে। এছাড়া রাসায়নিকের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য, বনভূমি, পানি, জলজ প্রাণী, পরিবেশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লালমনিরহাটের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, 'তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ নানা উদ্যোগ নেয়। তামাকের আবাদের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সচেতন করার পাশাপাশি বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের নানা প্রণোদনা দেয়া হয়। কিন্তু অধিক লাভের আশায় তামাকের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকরা আগ্রহ কম দেখান।'
তামাকের 'গ্রাসে' যেমন জনস্বাস্থ্য হুমকিতে রয়েছে, তেমনই কৃষি ও পরিবেশ রয়েছে নানা ঝুঁকিতে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের দুর্বল নীতি বা অবস্থান দেশের কৃষি জমি ধ্বংস, খাদ্য সংকট, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সমস্যার মতো বিষয়গুলোকে প্রকট করে তুলছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। এমন বাস্তবতায় সীমিত ভূখণ্ডের জনবহুল এ দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তামাকের মতো ক্ষতিকর দ্রব্যের উৎপাদন কমানো বা নিয়ন্ত্রণে আনতে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
-এমএ