অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে কার্যকর হচ্ছে না সরকারের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প। ঘরের দলিলসহ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না দরিদ্র পরিবারগুলো। সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের কথা বলছে স্থানীয় প্রশাসন।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের একটি অংশ দ্বীপ চর নিজাম চারপাশে মেঘনা নদী মাঝখানে ছোট-বড় দ্বীপচর। এখানেই বসতি স্থাপন করেছে নদী ভাঙ্গণে নিঃস্ব অন্তত সাত হাজার ছিন্নমূল মানুষ। দুর্গম এসব চরে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা।
ভাঙ্গণের কবলে পড়ে প্রতি বছর ভূমিহীন ও গৃহহীন হয়ে পড়ে এ অঞ্চলের হাজারো মানুষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে রাস্তার ওপর ঝুঁপড়ি ঘরে কিংবা খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রেই দুর্গম এ চরাঞ্চলের মানুষ বরাবরই অবহেলিত।
২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত চারটি গুচ্ছ গ্রামে ২৩০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় হয় ২০৬ কোটি টাকা। নির্মাণের তিন বছর পরও সেখানকার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য নিশ্চিত করা হয়নি তাদের প্রাপ্ত সুবিধা।
গুচ্ছগ্রাম বাসিন্দা ওহাব আলী জানান, আমরা এখন পর্যন্ত একটি ঘরেরও কাগজপত্র পাইনি। এখানে গুচ্ছগ্রাম থেকে বের হওয়ার নেই কোন রাস্তা। তাই এখনকার শিশুরা স্কুল যেতে পারে না। আমরা যেতে পারি না মসজিদে নামাজ পড়তে।
ভোলার সাত উপজেলার চরাঞ্চলে নির্মিত ১০ হাজার ৯২৮টি ঘরের মধ্যে এ যাবৎ ছয় হাজার ৪৮৯টি ঘর হতদরিদ্র মানুষের মাঝে বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাকিগুলো এখনও ফাঁকা পড়ে আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানের সুবিধা মাথায় না রেখে এভাবে দূর্গম চরে বসতি গড়ার নেপথ্যে রয়েছে অর্থ লুটপাট। যা ভাগাভাগি হয় ঘর নির্মাতা ঠিকাদার, প্রশাসনের কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে। ঘর বসবাসের জায়গায় হলো কি না তা নিয়ে চিন্তা নেই কারো। আর তাই ক্ষোভ স্থানীয়দের।
প্রকল্পের শর্তে রয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলে এমন এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুপেয় পানি আর কর্মসংস্থানের সুযোগের জায়গায় বানাতে হবে গুচ্ছগ্রাম।
তবে শর্ত ভঙ্গের দায় নিতে রাজি নন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
গুচ্ছগ্রাম বাসিন্দা রহিম আলী বয়াতি বলেন, গুচ্ছগ্রাম এলাকায় নেওয়ার আগে সরকার থেকে আমাদেরকে বলা হয়েছে প্রতিটি ঘরের সৌরবাতি দেবে। রান্না করতে দেবে গ্যাসের চুলা। কিস্তির মাধ্যমে আমাদের টাকা দেওয়া হবে। যাতে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে খেতে পারি। কিন্তু এখন দেখি তার কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে, ২০২১ সালের ২০ জুন চরফ্যাশন উপজেলার নীলকমল মুন্সিরহাট এলাকার দুটি স্থানে ১৮ ও ৩২টি মিলে ৫০টি ও ২৩ জানুয়ারী চরফ্যাশনের মাদ্রাজ, হাজারীগঞ্জ, চর মানিকা এবং জাহানপুর, চর কুকরি মুকরি পাঁচটিসহ ইউনিয়নে নির্মিত এই ৯০ ঘর দেওয়া হয়েছে গৃহহীনদের মাঝে।
সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে মুজিববর্ষ উপলক্ষে এই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘর পাওয়ার আগে নানা সমস্যার কথা বললেও সবুজ প্রকৃতির মাঝে ঘর পেয়ে খুশি নুরতাজ বেগম, কহিনুর ও সীমাসহ আরও অনেকেই।
তবে আশ্রয়ণের ঘর পেলেও এখনো নানা সমস্যার কথা বলেন আশ্রয়ণ প্রকল্প বাসিন্দা জমিলা খাতুন।
তিনি বলেন, এখানে আমাদের চলাফেরা করতে খুবই সমস্যা হয়। উঠানের মাঝে পানি জমে থাকে। পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই।
এই ঘর পাওয়ার পর সরকারি অন্য কোন সুবিধা বা ভাতা পান না বলে জানান রীনা বেগম, নুর নাহার ও আবুল কালাম।
সুরুজ মাঝি বলেন, পুকুরের ঘাট মেরামতসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে পড়তে হয় আমাদের। ঘরে তালা দিয়ে দূরে গেলে এলাকার মাস্তানরা এসে বলে তোমার ঘরে না থাকলে ঘর ছেড়ে দাও। এই ভয়ে তারা দূরে যেতে পারছেন কেউ কেউ। এমনকি যদি হসপিটালে দুই/এক দিনের জন্য গেলেও ঘর হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকছে।
তবে নীলকমল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন হাওলাদার বলেন, যখন যে সুবিধা আসে তা দেওয়ার চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে বিভিন্ন সুবিধার আওতায় আসবে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, সমাজের হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করতে পর্যাযক্রমে সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল নোমান বলেন, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প পানি উন্নয়ন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানসহ সকল সুবিধা খুব শিঘ্রই দেয়া হবে।
-এমএ