মেহেরপুরের গাংনীর কোদালকাটি গ্রামের রবিউলের ছেলে ছলিম ও সাবের। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। করোনা সঙ্কটে দুই ভাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে উপার্জনে নেমেছে।
লেদ মেশিনে কাজ করে তারা। সকাল থেকে রাত অবধি খেটে পরিবারের আহার নিশ্চিত করার লক্ষ্য তাদের। তাই স্কুলে যাওয়া নিয়েও তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। পরিবারের আয়ের পথ না থাকায় তারা বাধ্য হয়েই কাজে নেমেছে।
শুধু ছলিম ও সাবের নয়। মহামারি করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী হাল ধরেছে সংসারের। যে কচি হাতে বই, খাতা আর কলম ধরার কথা সেই হাতে অনেকেই ধরেছে রিকশা, ভ্যানের হাতল। শিক্ষার্থীরা অনেকেই কাজ করছে মোটর গ্যারেজ, কল কারখানায়। আবার অনেকেই নিয়োজিত হয়েছে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে। কেউ বা বই খাতা ছেড়ে বউ সেজে চলে গেছে শ্বশুর বাড়ি।
তবে, কর্তৃপক্ষ বলছে ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।
মেহেরপুর জেলায় ৩০৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৮৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১২০টি কেজি স্কুল ও মাদ্রাসা রয়েছে ২৫টি, রয়েছে ১৫টি কলেজ। এখানে অন্তত দু’লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী পারিবারিক প্রয়োজনে নেমেছে রোজগারের পথে। কোমলমতি এসব শিশু যাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোটাই এখন চ্যালেঞ্জ।
কুঞ্জনগরের মহসিন আলী বলেনন, বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাতি বক্কর ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালানো শুরু করে। দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজগার করে। টাকার লোভে এখন সে আর বিদ্যালয়ে যেতে চাইছে না।
গৃহবধূ মঞ্জুরা বলেন, স্বামী অন্য মেয়েকে বিয়ে করায় সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে সজীবকে কৃষি কাজে নামিয়েছি।
গাংনী উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সাজাহান রেজা বলেন, যেহেতু দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সেহেতু শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা সেটা বলা মুশকিল। তবে যেসব শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকবে তাদেরকে মনিটরিং করে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হবে।
গাংনী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মীর হাবিবুল বাশার বলেন, করোনা সঙ্কটে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। আর এ ঝড় থেকে পরিবারকে রক্ষায় শিক্ষার্থীদের কেউ হয়েছে উপার্জনের খুঁটি। অনেকে তার মেয়েকে বসিয়েছেন বাল্য বিয়ের পিঁড়িতে। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়েছে। তবে তার পরিসংখ্যান বিদ্যালয় ও শিক্ষা অফিসে নেই। এখন বিদ্যালয় খুলেছে তাই কয়েকদিন পর প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে। ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভূপেশ রঞ্জন রায় বলেন, যেহেতু এখন কম সিলেবাস তাই কাজও কম। হোম ভিজিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে জেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে একটি জরিপ চালানো হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আলাউদ্দীনের রিপোর্ট মোতাবেক উপজেলা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৮৮ জন।
অন্যদিকে মুজিবনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার বেলায়েত হোসেন বলেন, তার উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭ জন।
সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আপিল উদ্দীনের তথ্য মতে, সদর উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম-বেশি ৩০০ জন বলে জানা গেছে।
-এমএ