নওগাঁর আত্রাই উপজেলাধীন ব্রজপুর গ্রামের লবা প্রামাণিকের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে-মেয়ে মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে ১০ বছর ধরে শিকল বন্দি।
সুস্থ এক ছেলে পাগল হওয়ার ভয়ে বাড়ির ভিটা ছেড়ে অনত্র স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে এখনও স্বামীর বাড়িতে সুস্থ আছেন।
প্রতিবেশিরা মাঝে মধ্যে তাদেরও পাগলামীর কথা শুনতে পান বলে জানান। অভাবী বৃদ্ধ বাবা-মা সহায় সম্বল হারিয়ে সময়মতো খেতে দিতে পারেন না অসুস্থ সন্তানদের। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে শিকলে বন্দি করে রেখেছেন তাদের।
বৃদ্ধ লবা প্রামাণিকের কপালে জোটেনি বয়স্ক ভাতা। তিনিও সময় সময় বয়সের ভারে পাগলামি করে থাকেন। লবার স্ত্রী রাইজান মানুষের বাড়িতে কাজ করে কখনো চেয়ে এনে স্বামী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। সরকারি সহায়তা বলতে শুধুমাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল ক্রয়ের কার্ড আছে তাদের। দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে-পড়ে বাঁচতে এবং অসুস্থ সন্তানদের চিকিৎসা করাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করে আকুতি জানান অসহায় বৃদ্ধ দম্পতি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রজপুর বাজার সংলগ্ন ব্রজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গ্রামীণ রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে কিছু দূর যেতেই পাকা একটি বাড়ি। বাড়িটির গলি দিয়ে পশ্চিম দিকে কয়েক ধাপ দিতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে দরজা-জানালা বিহীন ভাঙ্গা বাড়ি। ব্রজপুর বাজারে গিয়ে লবা প্রামাণিকের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে ওই বাড়িতে অনেকগুলো পাগল আছে বলে জানান তারা।
বাড়ি তো নয় যেন ভাঙ্গা পাখির বাসা। বাড়ির ভেতরে তাকাতেই চোখে পড়বে উঠানে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে শিকলে বাঁধা মাঝ বয়সী মেয়ে নার্গিস। অনুরুপ ভাবে পশ্চিম ভিটায় দরজা-জানালা বিহীন মাটির কুঁরে ঘড়ের খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে মাঝ বয়সী সাইফুল। আবার সেখান থেকে পূর্ব দিকে তাকাতেই ভাঙ্গা চালার নিচে চোখে পড়বে শিকল বন্দি আরেক মেয়ে রোজিনা।
সম্পর্কে তারা আপন তিন ভাই-বোন। তাদের বিয়ে-সন্তান সবই হয়েছিল। তাদের সন্তানরা কেউ নানার বাড়ি, কেউ দাদার বাড়িতে বড় হচ্ছে বলে জানায় প্রতিবেশি সাজ্জাদ আলী।
এক সময় পরিবারের লোকজন তাবিজ-কবজ এবং কবিরাজি করতো। বাড়ির ভিটা এবং সন্তানের উপর কবিরাজির প্রভাব পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ কারণে এলাকায় পাগলের বাড়ি নামে পরিচিত এ বাড়িটি।
রাইজান বেগম বলেন, থালাতে করে খেতে দিলে আছরিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। যে কারণে দুর থেকে পলেথিনের প্যাকেটে করে খেতে দিতে হয়। তাদের দেখা শোনা করতে গিয়ে আমিও মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে যাই।
বাবা লবা প্রামাণিক বলেন, পাবনা পাগলা গারদে রেখে ছিলাম। কিছুদিন পর সেখান থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আমি কি করবো, সন্তানদের কি খাওয়াবো? কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না।
কথা হয় প্রতিবেশি হোসনে আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় ভালো পরিবার ছিল তারা। কোথা থেকে কি যে হলো তিন ছেলে মেয়ে অসুস্থ হয়ে পরিবারের সবকিছু উলোট পালট হয়ে গেল।
আহসানগঞ্জ ইউনিয়ন সদস্য আহসান হাবিব কায়েস বলেন, ইউনিয়নে আসা সরকারি অনুদানের পাশাপাশি আমরা প্রতিবেশিরা যখন যা পারি সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। স্থায়ী ভাবে সরকারি সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই।
আহসানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্কাছ আলী বলেন, 'আমার জানামতে একবার প্রতিবন্ধী অফিসে তাদের নাম পাঠিয়েছিলাম।'
প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা পি এম কামরুজ্জামান বলেন, 'আমার অফিসের মাধ্যমে সরঞ্জাম ছাড়া অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হয় না।'
সমাজসেবা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনাদের (সংবাদ কর্মী) মাধ্যমে জানতে পেলাম'।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকতেখারুল ইসলাম বলেন, 'সবেমাত্র চার মাস এ উপজেলায় যোগদান করেছি। বিষয়টি আজ জানলাম। সরেজমিনে তদন্ত করে সাধ্যমত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে'।
-এমএ