For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

তাদের জীবনে আলোর হদিস মেলেনা

Published : Wednesday, 17 February, 2021 at 8:55 PM Count : 548

সামাজিক অসম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দীর্ঘকাল ধরে আত্মীয় স্বজনহীন, বন্ধুবিহীন, অস্পৃশ্য জীবনের এক ভয়াবহ শাস্তি মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে রংপুরের ৩৭০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের। জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ। নাম পরিচয় যাই থাকুক না কেন ডাকে ‘হিজড়া; আবার কেউ ডাকে ‘ছক্কা’ বলে। নেই তাদের যথাযথ আবাসন, কর্মক্ষেত্র। অথচ পরিবারের সযত্নে এই মানুষেরা সমাজের বোঝা নয় হতে পারেন একেকজন সাবলম্বী মানুষ। কিন্তু সামাজিক হীনমন্যতায় এদের জায়গা হয়না পরিবারে। এমনই অভিযোগ রংপুরের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর। 

তৃতীয় লিঙ্গ দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা জানান, ‘আমাদের জায়গা পরিবারে হয়না, ‘বাড়িভাড়াও পাইনা। আমাদের কর্মক্ষেত্রও নেই। ফলে আমাদের সদস্যরা রাস্তায়, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চাঁদা তোলে। অনেকে বলেন সরকার নাকি আমাদের ভাতা দেয়। কিন্তু রংপুরে ভাতা পায় মাত্র ২জন। তাও ৬০০ টাকা করে। ভাতা পেতে হলে বয়স পঞ্চাশের বেশি হতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পঞ্চাশের আগেই আমাদের মৃত্যু হয়। সবার জীবনে আলো ছড়ায় আমাদের জীবনে আলোর হদিস মেলেনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বেশিকিছু চাইনা। একটা বাসস্থান আর কর্মের ব্যবস্থা করে দিন এতটুকুই চাওয়া।’

রংপুরের ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোট বেলায় আর দশটা শিশুর মতো তাদের কপালে আদর জুটলেও বড় হয়ে জোটে তিরস্কার, গঞ্জনা আর শাস্তি। ছোটবেলায় আঙ্গিক বৈসাদৃশ্য থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন তারা। সময়ের সাথে তাদের আচরণগত বৈসাদৃশ্য মেনে নিতে পারেন না বাবা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। অবশেষে বাড়ি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। মায়ের প্রচন্ড ভালবাসা পেলেও অধিকাংশ বাবাই যেন ভয়াবহ মুর্তি। মেনে নিতে পারেন না সন্তানের এমন আচরণ।   রংপুরের নুরপুরের একটি ৩ রুম বিশিষ্ট চালাঘরে বাস করছেন ৪৬ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। 

‘গাদাগাদি করেই কেটে যায় গ্রীষ্মের অসহনীয় গরম বা প্রচন্ড শীতের রাত। কেউই দিতে চায়না বাড়ি ভাড়া। যখন তখন আসে বাড়িওয়ালার বাড়ি ছাড়ার হুমকি। সকালে মুখ দেখলেই নাকি দিন খারাপ যায়। মেধা থাকলেও পরিবারের অযত্নে ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তা কোনদিন তা প্রকাশ পায় না। কি পাপ আমাদের?’ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কথা বলছিল তৃতীয় লিঙ্গের সোনালী। সোনালি তার দলীয় নাম। 
এ অভিযোগ শুধু সোনালীর নয়। সোনালীর মতো এখানে বসবাসকারী অনেকের। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মুন্নি বলেন, এই সমাজে একজন দুর্নীতিবাজের, ধর্ষকের, চোরাকারবারির, চোরের, খুনির পরিবারে জায়গা হলেও আমাদের পরিবারে জায়গা হয়না। আমাদের কোন কর্মসংস্থান নেই। কিন্তু পেটতো ক্ষুধা মানেনা। ফলে রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পাততে বাধ্য হই। লোকে বলে আমরা চাঁদাবাজি করি। আমাদের কাজ দেন। যেন পেট ভরে খেতে পারি, সমাজে অন্য সবার মতো চলতে পারি।’ 

‘বাড়ির জন্য মন কাঁদলেও সহজে মা-বাবাকে দেখেতে যেতে পারিনা। আমাদের বাবা-মাকে সমাজের মানুষ কটুক্তি করে। তাদের কষ্ট দেখতে পারিনা। আমার জন্য ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছিল না। তাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছি। ছোট বোনের বিয়ের পর একটা বাচ্চা হয়েছে। কিন্তু ৫বছর হল তার স্বামী বাচ্চাসহ আমার বোনকে বাসায় রেখে গেছে। আমার বোনের অপরাধ, আমি হিজড়া। কি দোষ আমার বোনের আর ওর ছোট্ট বাচ্চাটার?’-বলে চুপ হয়ে যান ইতি। ইতির জন্ম কুড়িগ্রামে হলেও কেবল তৃতীয় লিঙ্গ হবার কারণে তাকে বাস করতে হচ্ছে রংপুর মিঠাপুকুরে। অচেনা-অজানা জায়গায় স্বজনহীন ইতি থাকেন ঘর ভাড়া নিয়ে। তবে অনেকে সেই ঘরটাও তাকে ভাড়া দিতে চাননা। তাই ছোট করে হলেও একটা আবাসন কিংবা গুচ্ছগ্রামের দাবি জানান তিনি।

পপি সরকার বালারহাট আদর্শ ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। এটি তার দলীয় নাম। ১৬ বছর বয়সী এ যুবককে নিজের বাড়ি ছেড়ে, স্বজনদের ছেড়ে মেসে থাকতে হয়, ইচ্ছে হলেই মায়ের আদর পাওয়ার সুযোগ নেই তার। বাবার পাঠানো টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কতদূর চালিয়ে যেতে পারবে সেটাও অনিশ্চিত। 

পপি বলেন, ‘আমাদের সমাজ ভাল চোখে দেখে না। আমাদের কর্মসংস্থানও নেই। পড়াশোনা করে কি করবো জানি না।’

তৃতীয় লিঙ্গের আরেক সদস্য সাকিব বলেন, ‘রাস্তায় মেয়েদের দেখে কটুক্তি করলে ইভটিজিং করা হয়, শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আমরা সবসময়ই ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছি আমাদের জন্য আইন কোথায়? কোথায় আমার মৌলিক অধিকার? কে নিশ্চিত করবে। আমাদের দেখে আমাদের থেকে ছোট বয়সীরাও খারাপ ভাষা ব্যবহার করে। ওদের কথা শুনে মনে হয় আল্লাহ আমাদের এসব শোনার জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছে। আমাদেও জন্য বলার কেউ নেই। কেউ আমাদের নিয়ে ভাবে না। আর কতদিন আমরা সমাজের অন্ধকারে থাকবো? কে আমাদের আলো দেখাবে?’

এনিয়ে রংপুর সুজন সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জুর সাথে কথা হলে তিনি জানান, বহুকাল থেকে আমাদের সমাজের অবমূল্যবোধের কারণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পিছিয়ে আছে। তাদেরকে এখনও ভাসমান ভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তাদের সঠিক কর্মসংস্থান রাষ্ট্র এখনও সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে তারা বিয়ে বাড়িতে অথবা নবজাতকের বাড়িতে চাঁদা তোলে নয়তো রাস্তায়। মূলত আমরাই তাদের চাঁদাবাজি করতে বাধ্য করেছি। সঠিক আবাসন প্রদান ও তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দিলে তারা বোঝো নয় বরং জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তরান্বিত করতে পারবে।’ 

আশ্রয়ন প্রকল্প ও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারস্বরুপ বাড়ি তৃতীয় লিঙ্গের জন্য বরাদ্দ আছে কিনা জানতে চাইলে রংপুর জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান বলেন, ‘রংপুরে তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই রংপুর সিটি কর্পোরেশনে বসবাস করে। সিটির কর্পোরেশনের ভেতরে যদি কোন খাস জমি পাই তাহলে তাদের আবাসন গড়ে দেয়ার যাবে। হয়তো বেশি পরিমানে জমি পেলে একশ’ জনের আবাসন সিটির ভেতরেই করে দেয়া সম্ভব। আমরা এখন রংপুরে এমন জমি পাইনি এছাড়াও প্রত্যেক উপজেলা ইউএনওকে নির্দেশনা দেয়া আছে যেন তারা উপজেলাগুলোতে খাস জমির উপর তাদের আবাসন তৈরি করে দেয়। তাদের আবাসনও প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে।’

এইচএস

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,