For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

আজকের শহীদ মিনার যেভাবে গড়ে উঠেছে

Published : Monday, 1 February, 2021 at 10:53 PM Count : 330

আবারও ফিরে এলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ৫২’র ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জ্বলজ্বলে আত্মত্যাগ, গৌরব ও সাহসের স্মারক বহনকারী মাস। ফেব্রুয়ারি মাস মহান ভাষা শহীদদের স্মৃতি রোমন্থনকালে ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা ভাবলেই প্রথমেই কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে শহীদ মিনার। আজকের এই শহীদ মিনার যে প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার ভাষার জন্য শহীদের স্মরণে তৈরি হয়েছিল শহীদ মিনার। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে করা মিছিলে কাঁদানে গ্যাস ও গুলি চালানো হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারিতেও প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার। এতে শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকত, আউয়াল, শফিউরসহ অনেকে।তাদের এই মহান আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত। বর্তমান আমরা যে শহীদ মিনার দেখছি এর স্থপতি হলেন হামিদুর রহমান। তবে এই শহীদ মিনারটি কিন্তু সর্বপ্রথম তৈরি হয়নি। ক্রমানুযায়ী বিচার করতে গেলে এটির পূর্বে আরো কয়েকবার নির্মিত হয়েছিল শ্রদ্ধার পরিচায়ক এ স্মৃতিস্তম্ভ।

প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ হয় যেভাবে : ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্রজনতার মিছিলে গুলির ঘটনার পর ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শহীদ মিনার বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কথা মত কাজ শুরু হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় কারফিউ থাকা সত্ত্বেও ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কাজ শুরু হয়। শহীদ মিনারটি তৈরি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দারের নকশায় শুরু করে পুরো রাত কাজ করার পর শহীদ মিনারটি তৈরির কাজ শেষ হয়। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। আর ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম তাদের সহযোগীতা করেন দুজন রাজমিস্ত্রী।

বর্তমান শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) ১২ নং শেডের পূর্ব প্রান্তে হয়েছিল।মেডিকেল কলেজ সংস্কার ও সম্প্রসারণের নিমিত্তে রাখা ইট ও বালু এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে আনা সিমেন্ট দিয়ে সাড়ে দশ ফুট উঁচু (৩.২ মিটার) ও ৬ ফুট (১.৮ মিটার) চওড়া শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয়। পিয়ারু সর্দার ছিলেন পুরাতন ঢাকার পঞ্চায়েত সর্দারদের মধ্যে একজন, তার কাছে ছাত্ররা সহায়তা চাইলে তিনি নির্মাণের কাঁচামাল দিয়ে সাহায্য করেন। ভোর আলো ফোটার আগেই শেষ করা হয় নির্মাণ কাজ। এরপর কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে সামনে লিখে দেয়া হয় ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’।

২২ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ শফিউরের পিতা মাহবুবুর রহমান কর্তৃক অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করা হয়। ইতোমধ্যেই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে’শিরোনামে শহীদ মিনারের খবর ছাপা হয়। অতঃপর ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ওই দিন বিকেলবেলা পুলিশ মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এলাকা ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয়। পরে ঢাকা কলেজেও একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটিও সরকারের নির্দেশে ঘুড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠে।

জানা যায়, রাজশাহী সরকারী কলেজের ছাত্ররা ঢাকায় সর্বপ্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হবার আগেই ইট ও কাঁদা দিয়ে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন।সারা রাত জেগে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করার পর সকালে  পুলিশ গিয়ে তা ভেঙ্গে দেয়া এসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের পিকেটিং করে। রাজশাহীতে নির্মিত শহীদ মিনারে লেখা ছিল “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”

১৯৫২ সালে রাজশাহী কলেজে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ অপরাধ ট্রাইব্যুানেলর প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। তার মতে, রাজশাহীর শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২১ ফেব্রুয়ারিতেই এবং এক রাতেই এটি তৈরি করা হয়েছিল। এটিই যে প্রথম শহীদ মিনার সেটা প্রমাণের কোনো চেষ্টা তারা না করলেও সময়ের হিসেবে রাজশাহীর শহীদ মিনারটি ঢাকারটির আগেই তৈরি হয়েছিল বলেই অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রভাতফেরির সূত্রপাত : ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী শহীদ দিবস পালন করা হয় এবং লাল কাগজ দিয়ে একই স্থানে পূর্বের শহীদ মিনারের অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। এরপর সেটিকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়। সেখান থেকেই প্রথমবারের মত প্রভাতফেরি বের করে ছাত্ররা। এভাবেই প্রভাতফেরির সূত্রপাত হয়। পরের বছর (১৯৫৪ সাল) একই রূপে আবারও প্রভাতফেরি বের করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারিতে।

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ৩ রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ৯ মে এর অধিবেশনে তারা ঘোষণা দেন, তাদের ২১ দফা অনুযায়ী, শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণ করা হবে এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ আখ্যা দেয়া হবে। কিন্তু তারা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয় এবং ৩০ মে এই সরকারের পতন ঘটে। তবে ১৯৫৪ সালে একটি ছোট আকারের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় যার উদ্বোধন করেন নাট্যগুরু নুরুল মোমেন। বড় আকারে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে।

শহীদ মিনার (১৯৬৩-১৯৭১) : ১৯৫৬ সালে আবুল হোসেনের মুখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় পূর্তমন্ত্রী আবদুস সালাম খান শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একটি স্থানকে বাছাই করেন। পরবর্তীতে সেখানে জনৈক মন্ত্রীর শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা থাকলেও জনতার বিপুল আপত্তির মুখে তা না করে, ভাষাশহীদ রিকশাচালক আউয়ালের মেয়ে বসিরনকে দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করানো হয়।

১৯৫৬ সালে এ.কে. ফজলুল হক ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয় শহীদ দিবস এবং এতেই শহীদ মিনারের নির্মাণ প্রক্রিয়া বেগবান হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সম্মুখে শহীদ মিনার কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। স্থাপত্য নকশার দায়িত্ব পান হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ। ১৯৫৭ সালের ৯ নভেম্বর এটি তৈরির কাজ শুরু হয়। সামরিক আইন জারির কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়। তবে ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের নেতৃত্বাধীন কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে শহীদ মিনারের নকশায় পরিবর্তন এনে একে সংক্ষিপ্তাকারে শেষ করতে বলেন। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষাশহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগমের হাতে শহীদ মিনারটির স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন হয়। যদিও তখনো সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সের কাজ সম্পন্ন হয়নি।

হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদকে নিয়ে যে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছিল তা হলো- কেন্দ্রীয় বেদীতে অর্ধ-বৃত্তাকার কলাম মা ও তার ভূপতিত সন্তানদের নির্দেশ করবে।চোখে সূর্যের আলোর প্রতিফলন নির্দেশ করতে হলুদ ও গাঢ় নীলরঙা কাঁচ কলামগুলোতে বসানোর কথা ছিলো। মেঝেটি হবার কথা ছিল মার্বেল পাথরের যেন এই কলামগুলোর ছায়াসমূহের সময়ক্রমে স্থান পরিবর্তন এতে দেখা যায়।

বেদীর নিচে বেজমেন্টে ১৫০০ বর্গফুট (১৪০ বর্গমিটার) এর একটি প্রাচীরচিত্রে উল্লেখ থাকার কথা ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের। বাংলা অক্ষরযুক্ত একটি রেইলিং সৌধটির সামনে স্থাপনের কথা ছিল। আর লাল ও কালো রঙ্গা দুইটি পায়ের ছাপ অঙ্কনের কথা ছিলো যা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দুটো ভিন্ন দলকে নির্দেশ করে। একটি চোখ আকৃতির ঝরণা, একটি জাদুঘর এবং পাঠাগারও হামিদুর রহমানের নকশা পরিকল্পনায় ছিল।

হামিদুর রহমান এমনভাবে শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যাতে তা এই গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারে। সামরিক শাসন জারির পূর্বে ভিত্তি, বেদী, কিছু কলাম, রেইলিং, পায়ের ছাপ, দেয়ালে আঁকা ছবি ও অন্যান্য কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে যখন উদ্বোধন করা হয় তখন হামিদুর রহমানের নকশার বেশিরভাগ কাজই অসম্পূর্ণ ছিল।

এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা অভিযান অপারেশন সার্চলাইটর সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় এবং ধ্বংসাবসের ওপর ‘মসজিদ’লেখা সাইনবোর্ড দেয়। 
স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পুনরায় শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। তারা ১৯৬৩ সালের নকশার উপর ভিত্তি করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শহীদ মিনার তৈরি করতে সম্মত হন। এরপর ১৯৭৬ সালে নতুন নকশা অনুমোদিত হয় সেখানে ১৫০০ বর্গফুটের ভিত্তির ওপর চারটি ক্ষুদ্র ও একটি বৃহৎ কলাম মা ও তার ভূপতিত সন্তানদের নির্দেশ করে। এর পেছনে থাকবে একটি লাল সূর্য। এগুলো নির্মিত হয়েছিল উজ্বল মার্বেল পাথর দ্বারা। সিঁড়িতে ব্যবহার করা হবে সাদা রং যা একটি শুভ্র সৌম্য সৌন্দর্য এনে দেবে। প্রাচীরে রং করে লেখা থাকবে বিখ্যাত কবিদের কবিতা। কিন্তু এই পরিকল্পনা যথার্থরূপে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। নির্মাণকালে কলামগুলোর দৈর্ঘ্য পরিকল্পনানুসারে ধার্যকৃত দৈর্ঘ্যের থেকে কম হয়ে যায় এবং মুখ্য তথা বৃহৎ কলামটির মাথা পরিকল্পনার চেয়ে বেশি বাঁকানো করে তৈরি করা হয়। 

বর্তমান শহীদ মিনার : সবশেষ ১৯৮৩ সালে স্থপতি এস.এইচ.এম. আবুল বাশারের নেতৃত্বে শহীদ মিনারের এলাকা সম্প্রসারণ করে ত্রিকোণ থেকে চতুর্ভুজ আকারে তৈরি করা হয়। এই নতুন পরিকল্পনায় হামিদুর রহমানের নকশার দেয়ালচিত্র পরিকল্পনা বাতিল ও বেইজমেন্টের অংশটি বন্ধ হয়ে যায়। যা শহীদ মিনারের বর্তমান রূপ। বর্তমান শহীদ মিনারের উচ্চতা ১৪ মিটার (৪৬ ফুট)। 

সরকার ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট শহীদ মিনারের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণার্থে নয়টি নির্দেশনা দেন এবং জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণের নির্দেশ দেন। 

এইচএস


« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,