প্রাকৃতিক বনে ফিরে যাচ্ছে নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড়
Published : Monday, 26 August, 2024 at 11:18 AM Count : 240
জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড় ফের প্রাকৃতিক বনে ফিরে যাচ্ছে। স্থানীয়দের অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে একসময় প্রাকৃতিক বন উজার করে গারো পাহাড়ে সৃজন করা হয়েছিল বিদেশি জাতের আকাশমনি ও ইউকেলিপ্টাস গাছের উডলট বাগান। এসব বাগান সৃজন করার ফলে পাহাড়ের ঝিরি বা ঝর্ণাধারা বন্ধ হয়ে যায়। এতে হুমকির মুখে পড়ে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য।
তাই পরিবেশের ভারসাম্যের কথা বিবেচনা করে ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেষ্ট রেঞ্জের আওতাধীন পাহাড়ি বনে বিলুপ্তপ্রায় দেশিয় প্রজাতির গাছ দিয়ে সৃজন করা হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী মিশ্র বন বাগান। বর্তমানে সবুজে সবুজে ছেঁয়ে গেছে গারো পাহাড়। জেলার পর্যটন এলাকা হিসেবে এখানে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অবলোকন করতে দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণ পিয়াসীসহ অনেক পর্যটক ছুটে আসছেন এখন গারো পাহাড়ে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিগত ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে প্রাকৃতিক বন কেটে ন্যাড়া করে সৃজন করা হয় সামাজিক বন। এতে আকাশমনি, মিনজুরি ও ইউকেলিপটাস গাছ লাগানোর ফলে গারো পাহাড়ের জলবায়ু ও বন্যপশু, পাখিসহ জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ে। বিলুপ্ত হতে থাকে প্রাকৃতি ভাবে বেড়ে ওঠা বনজ গাছপালা। ২০০০ সাল থেকে পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে বন্যহাতির দল লোকালয়ে তাণ্ডব চালাতে থাকে।
এরপর থেকে বন বিভাগ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এসব পাহাড়ে পর্যায়ক্রমে বিলুপ্তপ্রায় গর্জন, ছাতিয়ান, হরিতকি, বহেরা, সোনালু, পলাশ, জারুল, ঢেউয়া, কাঞ্চন, জলপাই, শাল, পিতরাজ, অর্জুন, অশোক, আমলকি, আগর, কদম, কাঠবাদাম, কৃষ্ণচুড়া, কাঞ্চন, করছ, কামরাঙ্গা, গোলাপজাম, গাব, গামার, চিকরাশি, চালতা, চাম্পাফুল, চাপালিশ, জাম, জাম্বুরা, জগ্যডুমুর, ঢাকিজাম, তেঁতুল, তেলসুর, বড়ই, তুন, দেবদারু, নিম, নাগেশ্বর, পানিয়াল, বাজনা, বকুল, মহুয়া, রক্তচন্দন, রাবার, লোহাকাঠ শিলকড়ই, শিমুল, শিরিষ ও হলুদ গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া এসব বনভূমিতে প্রাকৃতিক ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাহাড়ি গাছও বেড়ে উঠছে। সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের বাতকুচি, সন্ধ্যাকুড়া ও সমশ্চুড়া বনবিটে মোট বনভূমি রয়েছে ৪ হাজার ২৩৫.২৮ একর। এর মধ্যে বিভিন্ন অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৩৪৫ হেক্টর বনভূমিতে দীর্ঘ মেয়াদী মিশ্র বাগান সৃজন করা হয়েছে। ফলে গারো পাহাড় এখন প্রাকৃতি বনে পরিনত হতে চলেছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ বন সৃজন করা হলে আগের মতো গারো পাহাড়ে বাঘ, ভাল্লুক, শূকর, হাতি, হরিণ, বনমোরগ ও শিয়াল-শকুনসহ বিভিন্ন জাতের বন্যপশু পাখির অভয়াশ্রম তৈরি হবে। সেই সাথে পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জলবায়ু বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
তাছাড়া, বর্তমানে গারো পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতি ও মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নিরসনে এই প্রাকৃতিক বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ওই প্রাকৃতিক বনের ভেতরে ফলজাত গাছের খাদ্য খেতে পেরে বন্যহাতির পাল আর লোকালয়ে তাণ্ডব চালাবে না। ফলে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। একইসঙ্গে প্রতিদিন গারো পাহাড়ি এলাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য ও বন্য পশু পাখি দেখতে ছুটে আসবেন। তাই এখানে পর্যটকদের জন্য সরকারি ভাবে হোটেল, মোটেল গড়ে তুলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারবেন।
বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বনজ সম্পদ বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় গারো পাহাড়ের মধুটিলা রেঞ্জে ইতোমধ্যে বেতবাগানসহ ৪০০ হেক্টর বনভূমিতে মিশ্র বাগান সৃজন করা হয়েছে। এই এলাকার বনভূমিতে পর্যায়ক্রমে আরো দীর্ঘ মেয়াদী মিশ্র বাগান সৃজন করা হবে।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, সৃজিত এসব মিশ্র বাগানে বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির বিভিন্ন গাছপালা ও ঔষধী গাছসহ প্রায় ৫০/৬০ প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এতে গারো পাহাড় আস্তে আস্তে আগের মতো প্রাকৃতিক বনে পরিণত হবে। বিলুপ্তপ্রায় এসব প্রজাতির আধিক্যের কারণে গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক কাজে লাগবে এ মিশ্র বন।
তিনি বলেন, গারো পাহাড়ি এলাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে মিশ্র বাগান সৃজন করা হচ্ছে। ওইসব বনে নতুন করে লতাগুল্ম সৃষ্টি হওয়ার কারণে বন্যহাতির খাদ্য সংকট দূর হবে। ফলে ক্ষুধার্ত হাতির পাল আর লোকালয়ে তাণ্ডব চালাবে না। এতে ভুক্তভোগীদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। পাশাপাশি গারো পাহাড় থেকে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ আহরণসহ প্রাকৃতি পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা পাবে।
-এমএস/এমএ