For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি ট্রাজেডির এক বছর, শুরু হয়নি সেতুর কাজ

Published : Monday, 25 September, 2023 at 11:41 AM Count : 537


পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবি ট্রাজেডির এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের এই দিনে নৌকাডুবিতে ৭২ জনের প্রাণহানি ঘটেছিলো নৌকাডুবির ঐ ঘটনায়। 

স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চগড়ের মানুষ একসঙ্গে এতোজনের মৃত্যু চোখে দেখেনি।

স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, আউলিয়ার ঘাটে সেতু নির্মাণের। দুর্ঘটনার পরে দেখতে আসা হাজার হাজার মানুষেরও দাবি ছিল অতি দ্রুত সেতু নির্মাণ হোক।
সে সময় মন্ত্রী, এমপি, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতিও ছিল আগামী মহালয়ার আগেই এখানে সেতু নির্মাণ হবে। কিন্তু বছর পেরিয়ে আবারো মহালয়া আসলেও সেতুর কাজ শুরু হয়নি। 

২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মহালায়ার উৎসবে যোগ দিতে যাবার পথে আউলিয়ার ঘাটে পূর্ণার্থীবাহী একটি নৌকা মাঝ নদীতে ডুবে যায় এবং ৭২ জনের সলিল সমাধি হয়। মৃতদের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৬জন, আটোয়ারীর দুইজন, ঠাকুরগাঁওয়ের তিনজন, দেবীগঞ্জের ১৯ জন ও পঞ্চগড় সদরের দুইজন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ৩০ জন নারী ও বাকি ২২ জন শিশু।

জানা যায়, বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বোদেশ্বরী মন্দির অবস্থিত। প্রতিবছর মহালয়ার দিনে এখানে কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগম ঘটে। এর মধ্যে প্রায়  অর্ধেক পূর্ণ্যার্থী আউলিয়া ঘাট থেকে নৌকায় করতোয়া পাড়ি দিয়ে বোদেশ্বরী মন্দিরে যান। তারই ধারাবাহিকতায় পূর্ণ্যার্থীবাহী নৌকাটি নদী পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে কিছু দূর যাওয়ার পরেই ডুবে যায় নৌকাটি এবং মুহূর্তেই উৎসব পরিণত হয় মর্মান্তিক শোকে। অনেকেই সাঁতরে তীরে উঠলেও নারী ও শিশুসহ বাকিরা ডুবে যায়। 
 

স্থানীয়রা তৎক্ষণাৎ উদ্ধার অভিযান শুরু করে ২৭ জন কে জীবিত উদ্ধার করে। আহতদের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কয়েকদিন ধরে প্রায় ৭০ জন জনবল নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৮০ কিলোমিটার ভাটিতে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদী থেকেও ভাসমান মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়দের ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের চেষ্টায় ৭২ টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। 


নৌকাডুবিতে বেঁচে ফেরা দিপু সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা বলেন, "আমরা মহালয়া অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ করে নৌকা দুলতে থাকে। তারপর আমি নিচে পড়ে যাই। কিছুক্ষণ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপর সাঁতার কাটলাম। আমি আমার নিজ হাতে তিনটা মরদেহ উদ্ধার করেছি। আরও কয়েকজনকে বাঁচিয়েছি।"

মর্মান্তিক এই নৌকাডুবিতে অনেক শিশু তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, অনেকে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা! আবার অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে যেন নির্বাক হয়ে গেছেন।

বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজী শিকারপুর গ্রামের বাসিন্দা হেমন্ত রায় বলেন,"আমাদের কোনও উৎসব নেই, আনন্দ নেই। আমাদের জীবনে কোনোদিন মনে হয় উৎসব ফিরেও আসবে না। স্ত্রী, মেয়ে, ভাইয়ের স্ত্রী, নাতনিদের হারিয়ে আমাদের দুটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। "

মাড়েয়া বটতলী এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী বালা বলেন, "মহালয়ার পূজা দিতে গিয়ে আমার উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে জগদিশ চন্দ্রকে হারিয়েছি। জগদিশের দুই অবুঝ শিশু স্বন্দীপ আর প্রিয়াংকা অনাথ হয়েছে। নৌকাডুবিতে জগদিশের সঙ্গে থাকা ভাতিজা সেন্টু চন্দ্রও (২৬) মারা গেছে। তাদের কথা মনে হলেই নিজেকে সামলাতে পারি না। অনেক কষ্ট বুকে চেপে অনাথ ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে আছি।"



এদিকে সেই সময় নৌকাডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে অর্থ সহায়তা করা হয়। 


এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় পঞ্চগড়ের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায়কে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। তদন্ত প্রতিবেদনে নৌকাডুবির কারণ হিসেবে ইজারাদারের গাফিলতি, অদক্ষ মাঝি, কুসংস্কার, ধর্মীয় অনুভূতি, অসচেতনতা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, নৌকায় ত্রুটিসহ বেশি কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি।

অন্যদিকে নৌযানের আকার ও আকৃতি বিবেচনায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তা সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করে ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘাট ইজারাদার ও দুইজন মাঝিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে একটি  মামলা দায়ের করেন। পরে ঐ মামলায় ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার এবং মাঝি বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা এখনো কারাগারে আটক এবং অপরজন পলাতক রয়েছেন।

এদিকে বছর ঘুরে সামনে আবারো মহালয়ার উৎসব চলে এসেছে। সেতু না থাকায় আবারো নৌকায় করে উৎসবে যোগ দিতে হবে পূন্যার্থীদের। এবার আনুষ্ঠানিকতায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। এ বিষয়ে বোদেশ্বরী মন্দির কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হরিশ চন্দ্র রায় বলেন, " এ বছর আমরা কোন ধরনের প্রচার প্রচারনায় যাচ্ছি না। অনুষ্ঠানের কোন পোস্টার, চিঠিপত্র ছাপানো হবে না। আয়োজন হবে সীমিত। তবে সেচ্ছায় পূন্যার্থীরা যদি আসেন তবে তাদের পুজা আর্চনার সুযোগ দেয়া হবে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে। যতদিন পর্যন্ত সেতু নির্মাণ না হবে ততদিন পর্যন্ত সীমিত আকারে মহালয়া উৎযাপান করা হবে।"


এদিকে গতবছরের ভয়াবহ নৌকাডুবির কথা মাথায় রেখে ইতমধ্যে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম জানান, "আমরা ঘাট ইজারাদার এবং মন্দির কমিটির সাথে কথা বলেছি। নিরাপদে যাতে মানুষ নদী পার হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। এছাড়া নৌকাডুবির মতো ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।" 

নৌকাডুবিতে ৭২ জনের মৃত্যুর পর সে সময় বেশ নড়েচড়ে বসেছিল জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসন। নৌকাডুবির পর গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রেলপথমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর বা চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে আউলিয়ার ঘাটে সেতু নির্মাণকাজ শুরু হবে। পরে অক্টোবরে সেতুর নির্মাণস্থল পরিদর্শনে আসে এলজিইডির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় আউলিয়ার ঘাটে প্রায় ১ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭ দশমিক ৩২ মিটার প্রস্থের ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ইতোমধ্যে একনেকে পাশ হয়েছে। যার ডিজাইনও চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর কোন রকম পদক্ষেপ বা দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি।

এদিকে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে নৌকাডুবিতে নিহতের স্মরনে বোদেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হচ্ছে "মহালয়া অক্ষয় স্মৃতি স্মরণিক"  স্মৃতিফলক। 

বোদা এবং দেবীগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী আউলিয়ার ঘাটে দ্রুত সেতু নির্মাণ। সকলের একটাই  চাওয়া আর যেন কাউকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার না হতে হয়! আর যেন কাউকে স্বামী-সন্তান হারা হতে না হয়!

এইচসি/এমবি

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,