শরীরের হাড় ভেঙে গেলে মানুষ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। আধুনিক ও ভবিষ্যতধর্মী চিকিৎসার মাধ্যমে অভিনব উপায়ে ভাঙা হাড়ের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা চলছে। সেই প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হলে রোগীরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন।
তিন মাস আগে মাউন্টেন বাইক দুর্ঘটনায় যে মার্সেল স্পানের হাত ও ঘাড় ভেঙে গিয়েছিল, তা আজ বিশ্বাস করা কঠিন। দুর্ঘটনার ঠিক পরের মুহূর্তে মার্সেল বুঝতে পারেন নি, যে তাঁর প্রাণ বিপন্ন। সৌভাগ্যবশত সাইক্লিস্টদের দলে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করেন। তারপর হাসপাতালে পুরো চিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞ হিসেবে রিশার্ড সেলেই মার্সেলের চিকিৎসা করেন। এক্সরে ও অন্যান্য রিপোর্ট দেখিয়ে তিনি মার্সেলকে বলেন, ‘‘এখানে ক্ষত ও হার্নিয়েটেড ডিস্ক দেখতে পাচ্ছেন। পেছন দিকেও শিরার ক্ষতি হয়েছে। সেটা সরে গেলে মেরুদণ্ডেরও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ছবিগুলি দেখলে ও ঘটনার বিবৃতি শুনলে বলতেই হবে, আপনার ভাগ্য সত্যি ভালো ছিল।''
রিশার্ড সেলেই দু-দুবার মার্সেল স্পানের শরীরে অপারেশন করেন। প্রথমে সামনে গলার উপর দিকে, তারপর পিঠে ছুরি চালিয়ে মেরুদণ্ড স্থিতিশীল করেন।
মেরুদণ্ডে ফ্র্যাকচার হলে আজকের দিনে কী করা সম্ভব, এমন অপারেশন তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। সেলেই প্রথমে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ডিস্কটি অপসারণ করেন। তারপর তথাকথিত ‘কেজ' বা ধাতুর তৈরি বিকল্প সেখানে বসিয়ে দেন। সব শেষে তিনি স্ক্রু দিয়ে হাড়ের মধ্যে নিখুঁত মাপের প্লেট লাগিয়ে মেরুদণ্ড শক্ত করে দেন।
টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি ইমপ্লান্ট ও মেরুদণ্ডের যতটা সম্ভব ‘হালকা' অপারেশন – আজকের এমন হাইটেক চিকিৎসার দৌলতে মার্সেলকে হুইলচেয়ারের উপর নির্ভর করতে হয়নি। তার ক্ষতের দাগগুলিও সেরে উঠেছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। রিশার্ড সেলেই অবশ্য স্বীকার করেন, ‘‘এটা ঠিক, যে আজও আমাদের ক্ষমতার সীমা রয়েছে। ইমপ্লান্টের কারণে সংক্রমণ, ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রে সমস্যা সামলাতে আমাদের হিমসিম খেতে হয়।''
সে কারণে বিজ্ঞানীরা হাড়গোড় ভাঙার চিকিৎসা আরও কার্যকরী করতে সব সময়ে নতুন থেরাপির সন্ধান করে চলেছেন। হেল্মহলৎস সেন্টারের আন্দ্রেয়াস লেন্ডলাইন তাঁদেরই অন্যতম।
গুরুতর কমিনিউটেড ফ্র্যাকচারের ক্ষেত্রে একাধিক হাড় নষ্ট হয়ে গেলে ভবিষ্যতে যাতে সেগুলি আবার একসঙ্গে গড়ে উঠতে পারে, মেটিরিয়াল রিসার্চার হিসেবে তিনি সেই কাজে সহায়তা করতে চান। তাঁর তৈরি এক ধরনের সাদা ফেনা নতুন হাড়ের টিস্যু গজানোর প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে পারে।
লেন্ডলাইনের তৈরি সেই ফেনা জিলেটিন ও লাইসিন নামের অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। তার মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। ভাঙা হাড়গুলির মাঝের খালি অংশে সেটি ভরা হলে কোষগুলি তার মধ্যে প্রবেশ করে নতুন হাড়ের টিস্যু তৈরির কাজ শুরু করে। অর্থাৎ নতুন হাড় গজানো পর্যন্ত সেই ফেনা ‘প্লেসহোল্ডার' হিসেবে কাজ করে। লেন্ডলাইন বলেন, ‘‘ভেতরে প্রবেশ করে এই সব কোষের এমন পরিবেশের প্রয়োজন হয়, যা স্পষ্ট বার্তা দেবে যে এখানে নতুন হাড় গজাবে। আমাদের এমন এক মৌলিক কাঠামোর প্রয়োজন, যার বিন্যাস বরাবর এই সব কোষ ঝুলতে পারে এবং বায়োমেকানিক্যাল তথ্য পাঠাতে পারে।''
লেন্ডলাইনের তৈরি ফেনা সেই কাঠামো সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে তিনি ও তাঁর টিম সত্যি দেখাতে পেরেছেন, যে সেই ফেনার মধ্যে কোষ জমা হয়ে বাড়তে শুরু করেছে। ছবিতে সবুজ ও নীল বিন্দু হিসেবে তা দেখা যাচ্ছে। নতুন হাড়ের টিস্যুর বৃদ্ধি ভাঙা অংশ ভরাট করে দিচ্ছে। তারপর ফেনা নিজে থেকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। আন্দ্রেয়াস লেন্ডলাইন সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘বহুকাল ধরে সেই লক্ষ্যে কাজ করার পর সাফল্য পেয়ে সত্যি অসাধারণ লাগছে। কারণ এমন বহুমুখী উপাদানের মধ্যে এত রকম চাহিদা পূরণ করতে হয়েছে।''
মানুষের হাড় ভাঙার পর ক্ষতের মধ্যে সেই উপাদান প্রয়োগ করলে শরীর সেটি গ্রহণ করবে কিনা এবং সেটি প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় উন্নত কিনা, ক্লিনিকাল স্টাডিজের মাধ্যমে তা যাচাই করতে হবে। প্লেট ও স্ক্রুর বদলে নিরাময়ের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফেনার প্রয়োগ এখনো ভবিষ্যতের কল্পনা বলে মনে হয়।
মার্সেল স্পানের শরীরে প্লেটগুলি স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। তবে তিনি বর্তমান থেরাপি নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট। সূত্র: ডয়েচে ভেলে।
এনএন