উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী উপজেলার খাল-বিলে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি।
বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় চার মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল, জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা। এক সময় শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এলাকার বয়স্কজনদের কাছে জানা গেছে, গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষরা অভাবী সংসারে এক সময় শাপলা খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতো। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলনার পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দর্যের আকর্ষণ। এ এলাকার গ্রামাঞ্চলের মাঠ, জলাশয়, ডোবা-নালা, পুকুরগুলো বৈশাখ মাসে পানিতে ভরে যায়। এরপর তিন-চার সপ্তাহ পরে এসব জলাশয় ভরে যেত সবুজ পাতা ও লাল শাপলায়। নয়নাভিরাম এসব দৃশ্য উপভোগ করতো সব বয়সের মানুষ। শিশুরা এ ফুল নিয়ে খেলনায় মেতে উঠতো।
উপজেলার মোকামিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুধীর মন্ডল (৭৫) বলেন, এ এলাকায় আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে বিভিন্ন জলাশয়ে অগণিত শাপলা ফুল ফুঁটে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে আগের মত আর লাল শাপলা ফুল দেখা যায় না।
তবে প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলে এখনো ফুটে থাকতে দেখা যায় লাল শাপলা। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে চলেছেন প্রকৃতি প্রেমীরা। কয়েক বছর আগেও বর্ষা কাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত মাঠের যেখানে বেশি জলাশয় সেই এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো রক্ত বর্ণের শাপলা বা লাল শাপলা।
বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। মনে হতো কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। এ দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না।
স্থানীয় ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে এবং বিক্রি করে। উপজেলার বিবিচিনি, বাসন্ডা, কেওড়াবুনিয়া, দেশান্তরকাঠী, ফুলতলা, গড়িয়াবুনিয়া, রানীপুর, জলিসা, ছোট মোকামিয়া, চালিতাবুনিয়া, চরখালী, মাসুয়াখালী, বদনীখালী, মায়ার হাট, চাঁন্দখালীসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বর্ষা মৌসুমে বড় বড় নৌকায় করে তাদের এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। এ শাপলা শহুরে জীবনেও খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগণের চাঁপের কারণে আবাদী জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বদ্ধজলাশয়ের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে।
তাছাড়া, জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল, বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে এ উপজেলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিপ্রবি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, সাধারণত শাপলা সাদা, হলুদ ও লাল তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা ফুলের শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এছাড়া শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম।
পবিপ্রবি খাদ্য ও পুষ্টিতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুজন মালী বলেন, প্রতি ১’শ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, এ্যাশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো, ক্যালোরি- প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাই মেটার ৮.৪, ক্রুড আমিষ ১৬.৮, ক্রুড ফ্যাট ২.৮ ক্রুড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ। '
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন মজুমদার বলেন, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ শাপলা সবজি হিসেবে খেতে গ্রামের মানুষের বদ্ধজলাশয়ে চাষ করা দরকার।
-এসকে/এমএ