রাজধানীতে যাত্রী পরিবহন সেবায় শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয় ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। কিন্তু সরকার পতনের পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় নগর পরিবহনের বাস চলাচল। একই সময় থেকে এ সেবা চালু করা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সব কার্যক্রমও বন্ধ। সব বাস তুলে নিয়েছে বিআরটিসিসহ অন্য বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এ রুটের নিয়মিত যাত্রীরা।
তবে কী কারণে এই পরিবহন সেবা বন্ধ হয়েছে, এখন করণীয় কী তাও ঠিক করতে পারছে না বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
২০১৫ সালে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তখন আনিসুল হককে আহ্বায়ক করে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন বলা হয়েছিল, ঢাকার পুরোনো ও জরাজীর্ণ বাসগুলো সরিয়ে চার হাজার নতুন বাস নামানো হবে। একটি রুটে একটি কোম্পানির অধীন চালানো হলে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা রোধ হবে, দুর্ঘটনা কমে ফিরবে শৃঙ্খলা।
২০১৭ সালে আনিসুল হক মারা যান। এরপর এই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ২০২০ সালে ডিএসসিসিতে মেয়র নির্বাচিত হয়ে এই কমিটির দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। আর কমিটির অন্যতম সদস্য হয়ে কাজ করেছেন ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৩ আগস্ট গোপনে দেশ ছাড়েন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থেকে আত্মগোপনে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। মূলত এর পর থেকেই নগর পরিবহন সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও নগর পরিবহন সেবা ফের চালু করতে মঙ্গলবার মতিঝিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) সামনে মানববন্ধন করেন যাত্রীরা।
২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত (২১ নম্বর রুট) ঢাকা নগর পরিবহন চালু হয়। এরপর ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের পাগলা (২৬ নম্বর রুট) ও ঘাটারচর থেকে রাজধানীর উত্তরায় (২২ নম্বর রুট) চালু হয় এই সেবা। এসব রুটে বিআরটিসির ৪০টি দ্বিতল বাসসহ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির দেড় শতাধিক বাস যাত্রী পরিবহন করতো। তবে শুরু থেকেই এসব বাসে যাতায়াতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তির অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ রাস্তা থেকে উধাও সব বাস।
ডিটিসিএ সূত্র জানায়, কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই নগর পরিবহন সেবা চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ফলে এ সেবার শুরু থেকেই যাত্রীদের প্রচুর অভিযোগ ছিল। তারপরও কারও কথা না শুনে ২৪ ও ২৫ নম্বর রুটও চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ তাপস। তার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের কারণে নগর পরিবহন আলোর মুখ দেখেনি। অথচ প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলে যাত্রী সেবা উন্নত বিশ্বের মতো হতো।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য ছিলেন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সম্প্রতি তিনি বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিতে একক ভাবে কর্তৃত্ব ছিল ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের। তিনি যা বুঝতেন, তা-ই সিদ্ধান্ত নিতেন। কারও কোনো কথা তিনি শুনতেন না। মালিক সমিতিকেও তিনি কোনো গুরুত্ব দেননি। ফলে সমীক্ষা ছাড়া এই পরিবহন চালু করায় সুফল পায়নি নগরবাসী।
জানতে চাইলে ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, ‘সাময়িক ভাবে নগর পরিবহন সেবা বন্ধ আছে।’ তবে এ সেবা কবে চালু হবে, তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি।
নগর পরিবহনের ২১ ও ২৬ নম্বর রুট চালুর দাবিতে মঙ্গলবার মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন এই পরিবহনে যাতায়াত করা শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ যোগ দেন। মানববন্ধন শেষে দাবি আদায়ে বিআরটিসি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বরাবর চিঠিও দিয়েছেন তারা।
বিআরটিসি'র পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল মোহাম্মদ মোবারক হোসেন মজুমদার বলেন, ‘ঢাকা নগর পরিবহন মূলত বিআরটিসিসহ কয়েকটি কোম্পানির বাস দিয়ে পরিচালিত হতো। কিন্তু ওই দুটি রুটে বাস চালাতে গিয়ে গত দুই বছরে বিআরটিসির প্রায় আট কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। কারণ, বাস রুট রেশনালাইজেশনের সিদ্ধান্ত ছিল ২১ ও ২৬ নম্বর রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস ছাড়া অন্য কোনো পরিবহনের বাস যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। অথচ বাস্তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। ফলে বিআরটিসি বাসে যাত্রী সংকট থাকতো।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর ২৬ নম্বর রুটে বিআরটিসি বাসে যাত্রী পরিবহন বন্ধ। ২১ নম্বর রুটে পাঁচ থেকে সাতটি বাস চলছে। এখন শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ওই রুটগুলোতে বিআরটিসি বাস বাড়ানো হবে।’
-এমএ