সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি কমছে। তবে পানি এখনো বিপৎসীমার উপরে থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যার কারনে জেলার পাঁচ উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নে ২০ হাজার ৩২৯টি পরিবারের ৯৪ হাজার ৯৩৬ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল। পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রয়েছে ৭৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্যাদুর্গত এসব মানুষের জন্য ইতোমধ্যে ১০৩ টন চাল, ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার জানান, মঙ্গলবার (৯ জুলাই) দুপুরে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে গত ১৮ ঘণ্টায় পানি ৯ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে গত ১৮ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, জেলার পাঁচ উপজেলার ৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রোজিনা আক্তার জানান, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলে জেলার ১৬টি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বাবুল কুমার সূত্রধর বলেন, এ পর্যন্ত জেলার পাঁচ উপজেলায় ৬হাজার ৫২৫ হেক্টর জমির পাট, তিল, কলা ও মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে পানি প্রবেশ করায় এই সকল ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আকতারুজ্জামান বলেন, বন্যায় সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর পাঁচ উপজেলায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট ৯৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ২১হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ১০৩ টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা, ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
সিভিল সার্জন ডাঃ রামপদ রায় জানান, বন্যা আক্রান্ত পাঁচ উপজেলায় রোগ বালাই মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসক সহ ৫১টি টিম কাজ করছে।
এদিকে বন্যার কারনে জেলার বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙ্গন অব্যাহত আছে। জেলার চৌহালীতে গত দশদিন ধরে ব্যাপক নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে চর ছলিমাবাদ দক্ষিণ পাড়া কবরস্থান ভেঙ্গে গিয়ে গত চার দিনে ১০-১৫ মরদেহ নদীর তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া কয়েকটি মরদেহ স্বজনেরা উদ্ধার করে অন্যত্র কবর দিয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কাজীপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ি, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিস, শাহজাদপুর উপজেলার হাটপাচিল, জালালপুর, কৈজুড়ী চৌহালী উপজেলার ভুতেরমোড় এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দেয়। গত চার দিন হলো চৌহালীতে ভুতের মোড় থেকে চর ছলিমাবাদ দক্ষিণা পাড়া (ময়নাল সরকারের কবরস্থান) পর্যন্ত তীব্র নদী ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙন রোধে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
চৌহালীর ময়নাল সরকারের কবরস্থান এলাকার কামরুল ইসলাম বলেন, গত চার দিন হলো চৌহালী উপজেলার ভুতের মোড় থেকে ময়নাল সরকারের কবরস্থান পর্যন্ত তীব্র নদী ভাঙন শুরু হয়। ইতিমধ্যে কবরস্থানের অধিকাংশ জায়গা নদীতে ধসে পড়েছে। আমার ফুপা সন্তেস আলী শিকদার প্রায় ৪০ দিন আগে মারা গেছে। তার মরদেহও নদীতে ধসে পড়লে তা উদ্ধার করে অন্যত্র কবর দেয়া হয়েছে। ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষ পেতে তাহেজ ফকির, সোহার সরকারের মাযের এবং বুদ্দু শিকদারের মায়ের মরদেহ উদ্ধার করে অন্যত্র কবর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনেক মরদেহ নদীর তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে।’
চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম মোল্লা বলেন, ভাঙ্গনের কারনে ‘কবরস্থানের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। অনেক মরদেহ ভাসতে দেখেছি। অনেকে তাদের পারবারের মরদেহ সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র কবর দিচ্ছে। কয়েকটি মরদেহ নদী তে ভেসে গেছে। ভাঙ্গন রোধে এই এলাকায় বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহবুব হাসান বলেন, যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দিন ধরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কবরস্থানের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। কিছু মরদেহ বেরিয়ে নদীতে পড়েছে। পরে তাদের স্বজনেরা মরদেহ উদ্ধার করে অন্যত্র কবরস্থ করেছে। ভাঙ্গন রোধে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে এই এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় জেলার অরক্ষিত নদী তীর এলাকায় ভাঙনের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। তবে ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) দুপুরে কাজিপুরের বিভিন্ন ভাঙ্গন কবলিত এলাকা ও মাইজবাড়ি স্পার বাঁধ পরিদর্শন করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মুখলেসুর রহমান বলেন, মেঘাই স্পার বাঁধ, হাঁটপাটিল ও চৌহালী উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোর প্রতি আমরা সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রেখেছি। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা এসব অঞ্চল নজরদারিতে রেখেছে। সকল প্রস্ততি আমাদের রয়েছে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক জিওব্যাগ বা জিওটিউব ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করা হবে।
এবি/এসআর