ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানি নেমে গেলেও এখনো দুর্ভোগ কমেনি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত চরগুলোর বাসিন্দাদের। রেমালে উপজেলার সাগর মোহনার ঢালচর, চর মোতাহার, চর মানিকা, কলমি চর কুকরি মুকরি ও তেতুলিয়ার পাড়ের মজিবনগরসহ উপজেলার নয় ইউনিয়নের প্রায় ২০টি বিচ্ছিন্ন দ্বীপচরের মানুষ হয়েছে পানিবন্দি। নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
দূষিত পানি পান ও জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে চলাফেরা করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ঘরে ঘরে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৩ দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। ফলে চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন স্থানীয় লোকজন।
ক্ষতিগ্রস্ত চর এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগী, চার জন পল্লী চিকিৎসক, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) সঙ্গে কথা বলে এমন পরিস্থিতির তথ্য জানা যায়।
চরফ্যাশন উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন ঢালচরে দুই শতাধিক পুকুর আছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় এসব পুকুর জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। অনেক পুকুরের পাড় ভেঙে নদীর সঙ্গে সরাসরি নালা সৃষ্টি হওয়ায় এখন নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। পুকুর ও খালের পানি ছাড়াও ঢাল চরের তিন দিকে নদী ও একদিকে সাগর হওয়ায় ঢাল চরবাসীকে বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। রোগের মধ্যে আছে অ্যালার্জি, জ্বর, পাতলা পায়খানা ও আমাশয়।
ঢাল চরের আনন্দবাজারের বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মাঝি জানান, তার ছেলে ছাব্বির হোসেনের (১০) চুলকানি ও জ্বর। ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
ঢাল চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার জানান, ঢাল চরে প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসবাস। ১২-১৩ দিন আগে এখানে ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হেনেছে। এরই মধ্যে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। চরের মানুষের ঘরে ঘরে জ্বর, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া ও অ্যালার্জি দেখা যাচ্ছে। এখানে কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। নেই কমিউনিটি ক্লিনিকও। বার বার বলা সত্তেও এ বিষয়ে কেউ কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
ঢাল চর ইউনিয়নের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মো. শরীফুল ইসলাম সওদাগর জানান, ঢাল চরে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। এখন ধরতে গেলে একটিরও কার্যক্রম নেই। কারণ, তিনটি ক্লিনিক নদী ভাঙন বিলীন হয়ে গেছে। শেষ ক্লিনিকটি তিনি পরিচালনা করতেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের একটি কক্ষে। সেখানেও ঘূর্ণিঝড় রেমাল দুর্গত মানুষের মালামাল এমন ভাবে রাখা হয়েছে, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া মতো অবস্থা নেই।
এদিকে, ঢাল চরে অতিরিক্ত লবণ পানিতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অতিরিক্ত গরমেও মানুষ অতিষ্ঠ। পুকুরভর্তি লবণ পানি পরিবর্তন ছাড়াও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ করা প্রয়োজন।
ঢাল চরে চার জন পল্লী চিকিৎসক আছেন। তাদের মধ্যে প্রবীণ পল্লী চিকিৎসক মফিজুল ইসলাম ও মো. ইকবাল হোসেন জানান, তাদের এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। লবণ পানির কারণে ঢাল চরে এখন অতিরিক্ত গরম পড়েছে। ঢাল চরে ঘুরে কিছু পুকুরের পাড় ভাঙা দেখা যায়। ভাঙা অংশের সঙ্গে নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানির সংযোগ তৈরি হয়েছে। জোয়ারের সময় পথ-ঘাট লবণ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। ঢাল চরের আনন্দবাজার, আদর্শপাড়া, ভদ্রপাড়াসহ পূর্বাংশে দুই শতাধিক পরিবারের বাস। তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কারণে-অকারণে লবণ পানিতে নামতে হচ্ছে। ঘরের শিশু-নারীরাও থালাবাসন ধোয়ার কাজ করছেন লবণ পানিতে। গভীর নলকূপের পানিতে গোসল ও রান্নার কাজ সারলেও অন্য কাজে লবণ পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। একমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিকটি জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে খাদের পাড়ে কাত হয়ে পড়ে আছে। সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ। স্থানীয় বেশির ভাগ মানুষের গায়ে ঘামাচি ও ফোঁড়ার মতো উঠেছে। চুলকাতে চুলকাতে তাদের অবস্থা খারাপ।
ঢাল চরের আনন্দবাজারের বাসিন্দা মো. মাহে আলমের তিন সন্তান। ১০ বছর বয়সী ছেলে মোজাহিদুল ইসলামের জ্বর ও চুলকানি। পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে বিবি আয়েশার জ্বর, সর্দি-কাশি ও চুলকানিতে অস্থির।
মো. শাহাবুদ্দিন জানান, হাফিজি মাদ্রাসায় পড়া তার ৯ বছর বয়সী ছেলে মো. রাসেলের কয়েক দিন ধরে অতিরিক্ত জ্বর। ওষুধ খাওয়ালে জ্বর কমলেও আবার বেড়ে যায়।
ঢাল চরের প্রবীণ বাসিন্দা বাৎসু ফরাজি, নাজিম পাটওয়ারী ও মো. কাওসার জানান, ৫০-৫৫ বছর আগে তারা এ চরে যৌবনের শুরুতে এসেছেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের মতো উঁচু ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাস তারা দেখেননি। আর পানিও এমন বিষাক্ত লবণ ছিল না। এই পানি পুকুর থেকে দ্রুত না সরাতে পারলে এলাকার মানুষের রোগ-শোক কমবে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা শোভন কুমার বসাক জানান, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে প্রভাব থাকে। সুপেয় পানির শূন্যতা দেখা দেয়, পানির ঘনত্ব বাড়ে। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগগুলো বাড়ে। পেট ব্যথা ও বমি হতে পারে। আর লবণ পানির কারণেও শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রোগ-শোক বৃদ্ধি পায়।
তিনি জানান, এখন তাদের অনেক করণীয় আছে। কিন্তু ঢাল চরের সব কমিউনিটি ক্লিনিক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ওই এলাকার স্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটি চিকিৎসক দল পাঠানোর চেষ্টা করবেন তিনি।
-এসএফ/এমএ