বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। চিকিৎসক কোনো পরীক্ষা করতে না বললেও দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার রোগী।
এমনকি স্যাম্পল (নমুনা) নিয়ে তা ফেলে দিয়ে ‘মনগড়া’ রিপোর্টে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে। রাজশাহীজুড়ে প্রায় ঘটছে এমন ঘটনা। এতে ভোগান্তিতে আছেন সাধারণ মানুষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় অনুমোদিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ ব্লাড ব্যাংক রয়েছে ২ হাজার ৮৩টি। এরমধ্যে ক্লিনিক ৭৭৭টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১ হাজার ২৯০টি এবং ১৬টি রয়েছে ব্লাড ব্যাংক। এ বিভাগে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে অবৈধ। আর রাজশাহী জেলায় প্রাইভেট ক্লিনিক রয়েছে ১২১টি। এছাড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২২৬টি এবং ব্লাড ব্যাংক রয়েছে ৪টি।
তথ্যমতে, মহানগরীর লক্ষীপুর এলাকা ‘ক্লিনিকপাড়া’ হিসেবে পরিচিত। এলাকাটিতে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে কয়েকটি প্রতারক চক্র। এতে জড়িত রয়েছেন চিকিৎসক, ডায়াগনস্টিক মালিক, কথিত মার্কেটিং অফিসারসহ রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি এবং অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারক চক্রে যুক্ত হয়েছে ‘রানার বয়’ নামে নতুন একটি পদ। চিকিৎসকদের চেম্বারের আশপাশে ওঁৎ পেতে থাকেন তারা। রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে যান নিজেদের চুক্তিতে থাকা ডায়াগনস্টিকে। চিকিৎসক পরীক্ষা না দিলেও নিজেদের ইচ্ছেমতো পরীক্ষা করিয়ে কমিশন তোলেন। রোগীপ্রতি সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ কমিশন পান তারা।
লক্ষীপুরে চিকিৎসক দেখাতে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর এলাকার গোলাম আজম। ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসক তার কোনো পরীক্ষা না লিখলেও সিবিসি, বিলিরুবিন ও এসজিপিটিসহ কয়েকটি পরীক্ষা করিয়েছেন রবিউল ইসলাম রবি নামে এক যুবক। তার সঙ্গে ডা. মো. রাকিব সাদি নামের ওই চিকিৎসকের সহকারী পরিচয়ে একজন যুবক ছিলেন। তারা জানান, গোলাম আজম তাদের বন্ধু। সেজন্য তার পরীক্ষা করিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক জানান, টেস্ট লিখলেই কমিশন পান চিকিৎসকরা। সফটওয়্যারে অটোমেটিক নাম উঠে যায় এবং মাসিক হিসেবে কমিশন ঢুকে চিকিৎসকদের একাউন্টে। পিতামাতার পরীক্ষা করিয়ে কমিশন নেন সন্তান, আবার সন্তানের পরীক্ষার কমিশন খান বাবা। পপুলার ডায়ানস্টিক সেন্টার বাংলাদেশে প্রথম এ কমিশন সিস্টেম চালু করে বলেও তিনি জানান।
ওই মালিক আরও বলেন, দুহাজার টাকার টেস্ট করিয়ে কৌশলে নেওয়া হয় ৮-১০ হাজার টাকা। আমি কয়েকদিন আগে একজন গরিব মানুষের ১০ হাজার টাকা তুলে দিলাম। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান টেস্ট না করেই কম্পিউটারে প্রিন্ট করে রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়, স্যাম্পল ফেলে দেয়। তবে মাস্তানদের হামলার আশঙ্কায় ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বলেননি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহানগরীর ঝাউতলা মোড়ের কাছে একটি গ্যারেজ থেকে গাড়ি গিয়ে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী নিয়ে আসা হয়। এ তিন জেলা থেকে রাজশাহীতে প্রায় ৫০ শতাংশ রোগী আসে।
আবার সরেজমিন ঘুরে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখা যায়। ছিল না অগ্নিনির্বাপন ও বর্জ্য অবসারণ ব্যবস্থা। এছাড়া প্যাথলজি ল্যাবে শিশুসহ সাধারণ মানুষের চলাফেরাও দেখা গেছে।
এদিকে, স্থানীয়দের অভিযোগ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জন্য লক্ষিপুর এলাকায় তৈরি হচ্ছে নানা সমস্যা। সড়কের একপাশে বন্ধ করা হয়েছে ওই ডায়ানস্টিককে সুবিধা দিতে। যানজটের ফলে দুর্ভোগে পড়ছেন রোগী ও পথচারিরা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি টাকা নেয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার রাজশাহী ব্রাঞ্চের প্রধান ফরিদ মো. শামীম বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক।
এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক। তিনি বলেন, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের কাজ চলমান আছে এবং প্রতিদিন এটা চলতে থাকবে। প্রতিনিয়ত আমরা বের হচ্ছি।
আরএইচএফ/এসআর