For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

দেশজুড়ে বাড়ছে রাজশাহীর খেজুর গুড়ের চাহিদা

Published : Sunday, 18 February, 2024 at 6:27 PM Count : 120

শীতকালের শেষ পর্যায়ে। এতোদিন বইছিল শীতের আমেজ। নতুন ধানের চালে তৈরি পিঠা-পুলি খাওয়া এখনও শেষ হয়নি। এসব খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে গুড়। রাজশাহীর উপজেলাগুলোতে নানা পদের গুড় তৈরি হয়।

গুড়ে মূল উপকরণ ভিন্ন হলেও তৈরির প্রক্রিয়া একই। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হয়। রসের ঘনত্বের তারতম্যের ওপর এর নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

চামটা জেলার চারঘাট উপজেলার একটি গ্রাম। ঘড়ির কাঁটা তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। ফজরের আজান শেষ হয়েছে। এর মধ্যে এক হাতে হাঁড়ি নিয়ে ৪০ ফুট লম্বা খেজুরগাছে তরতর করে উঠে গেলেন আবদুল হান্নান। হাঁড়িভর্তি রস নামিয়ে এনে সাইকেলে লাগানো জারকিনে ঢেলে দিলেন। কথা বলতে চাইলে হান্নান বললেন, ‘এখুন কথা বুলার সুমায় নাই যে ভাই। আরও ২০টা গাছের রস নামান্যা বাকি।’ খেজুরের রস নিয়ে রোজ ভোরে হান্নানের খুব ব্যস্ততা। রস নামানো, সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো। খেজুরের রস নিয়ে খাজুরে আলাপ করার সময় কোথায়!

হান্নানের মতো রাজশাহীর পুঠিয়া, চারঘাট আর বাঘা উপজেলার গাছিদের ব্যস্ততা এখন খেজুরের রস-গুড় নিয়ে। ভোরের আলো ফোটার আগেই মাঘের শীত গায়ে মেখে তারা বেরিয়ে পড়ছেন সাইকেল নিয়ে। একটার পর একটা গাছের রস নামিয়ে ফিরছেন বাড়ি। তারপর রস জ্বাল দিয়ে শুরু হচ্ছে গুড় বানানোর কাজ। এ কাজটা করে দিচ্ছেন বাড়ির নারীরা। পুরুষেরা আবার সেই গুড় বিক্রি করে আসছেন হাটে। খেজুরের গুড় বিক্রির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা অনলাইনে বিক্রি করছেন খাঁটি খেজুরের গুড়।
তাওয়ার ওপর পরিষ্কার কাপড় ধরে জারকিন থেকে খেজুরের রস ঢেলে দেওয়া হয়। সেই রস পড়ে তাওয়ায়। জ্বাল দেওয়ার আগে এভাবেই রস ছেঁকে নেওয়া হয়। সকালে গাছিদের বাড়িতে গেলে টাটকা খেজুরের রস আর মুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। অতিথিদের জন্য খেজুরের জ্বাল দেওয়া রস দিয়ে রান্না হয় পায়েস। খাঁটি খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় নানা রকম শীতের পিঠা।

গাছিদের সবারই নিজেদের খেজুরের গাছ নেই। গাছের মালিকদের কাছ থেকে তারা এক মৌসুমের জন্য ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় গাছ ইজারা নেন। তারপর গাছ কেটে প্রস্তুত করেন শীতের শুরুতেই। রস নামার সময় হলে গাছে-গাছে নলির সাথে বেঁধে দেন মাটির হাঁড়ি। গাছিরা এসব হাঁড়িকে বলেন ‘কোর’। টলটলে রস পেতে কোরের ভেতরে মাখিয়ে দেয় কিছুটা চুন। ভোরে রস নামাতে গাছিরা সাইকেলে বাঁধা জারকিন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে রস আনার পর কাপড়ে ছেঁকে তা দেওয়া হয় চুলোয় বসানো তাওয়ায়।

তারপর বাড়ির নারীরা জ্বাল দিতে থাকেন চুলোয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাষ্প হয়ে উড়তে থাকে খেজুরের রসের মিষ্টি গন্ধ। জ্বাল দিতে দিতে একটা সময় তাওয়ায় থাকে শুধু নালি গুড়। অনেকে এই নালি গুড়ই বয়ামে ভরে বিক্রি করেন। কেউ কেউ আবার এই নালি গুড় ফর্মায় বসিয়ে করেন খেজুর গুড়ের পাটালি। পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘার বাড়ির উঠোনে উঠোনে চলে এমন কর্মযজ্ঞ।

রাজশাহীতে চলতি মৌসুমে ৮ হাজার ৮২৪ টন খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। প্রায় ১১ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩টি খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রস দিয়ে এই গুড় উৎপাদন করা হবে। এছাড়া খেজুরের রস ও গুড় থেকে ১৪৯ কোটি ৯৯ লাখ ৩১ হাজার ২০৩ টাকার সম্ভাব্য বাণিজ্যেরও প্রত্যাশা করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর নয়টি উপজেলার প্রায় প্রতিটিতেই সংগ্রহ করা হয় খেজুরের রস। জেলার ৫৪৪ দশমিক ৩৭ হেক্টরের মধ্যে শুধু পুঠিয়ায় খেজুরের গাছ রয়েছে ২৯০ হেক্টর জমিতে। রস সংগ্রহের পর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তৈরি হয় গুড়। এসব গুড় রাজশাহী ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানি হয়। পাঠানো হচ্ছে বিদেশেও।

শীত মৌসুমে প্রতি বছরই রাজশাহী অঞ্চলে গাছ তৈরি, রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি, বাজারজাত ও পরিবহনসহ সব মিলিয়ে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মৌসুমী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কানপাড়াহাট, সিংগাহাট, পুঠিয়ার বানেশ্বর, চারঘাট এবং পবা উপজেলাসহ নগরীর মোকামগুলোয় গুড় বিক্রি করা হয়।

গ্রামাঞ্চল থেকে এসব মোকামে গুড় পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয় ভ্যান। এর ফলে কয়েক হাজার ভ্যানচালকের কর্মসংস্থান হয়। পাশাপাশি মোকামগুলো থেকে ট্রাকে করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় গুড়। এ কারণে গুড় মৌসুমে জমজমাট হয়ে ওঠে ট্রাক মালিকদের ব্যবসা। একই সঙ্গে অনেক তরুণ উদ্যোক্তাও এ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় মোট খেজুর চাষি আছেন ৪৯ হাজার ৭১১ জন। খেজুরের গুড় ব্যবসায়ী রয়েছেন ৬৪৪ জন। এছাড়া এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন অন্তত ২১ হাজার ৮৫৬ জন। মৌসুমে একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ থেকে ২৩ দশমিক ৫২৩ কেজি রস আসে। এবার জেলাজুড়ে সম্ভাব্য রস উৎপাদন হবে ২৪ হাজার ২৫৮ দশমিক ১৪ টন। এ থেকে গুড় উৎপাদন হতে পারে ৯ হাজার ১৪০ দশমিক ৩৪ টন। বর্তমানে রাজশাহীতে ৯০টি গুড়ের আড়ত রয়েছে। এসব আড়তে টনপ্রতি গুড়ের বর্তমান বাজার দর ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা।

চারঘাট উপজেলার সারদা এলাকার চাষি আবদুর রহমান বলেন, আমার জমির আইল এবং পুকুরপাড়ে ১৫০টি খেজুর গাছ আছে। সব গাছ থেকেই আমি রস সংগ্রহ করি। রস নামানোর জন্য লোক রাখা হয়েছে। তারা ভোরবেলায় এসে রস নামিয়ে নিয়ে যায়। আবার নতুন হাঁড়ি লাগিয়ে রাখে। এই মৌসুমে আমার খেজুরের রস থেকে আয় হয়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা।

পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর এলাকার দিলারা বেগম দিনমজুর হিসেবে খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করেন। তিনি বলেন, প্রতি মৌসুমে আমি গুড় তৈরির কাজ করি। মালিকের কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে দিনপ্রতি ৫০০ টাকা পাই। শীত মৌসুমে আমার মত প্রায় ৩০ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।

রাজশাহীর বৃহৎ খেজুর গুড়ের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর ও ঝলমলিয়া বাজার। তবে কয়েক বছর ধরে উৎপাদিত গুড় শুধু এ দুটি হাটে কেনাবেচায় সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিদিন এ এলাকার খেজুর গুড়ের একটি বড় অংশ অনলাইন মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে দেশের সব অঞ্চলের ক্রেতার কাছে। এলাকার যুবকেরাই অনলাইনে গুড় বিক্রি করছেন।

উপজেলার গুড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে বানেশ্বর হাট। আর সোম ও বৃহস্পতিবার ঝলমলিয়া হাট বসে। এখন খেজুর গুড়ের বাজার পুরোদমে জমে উঠেছে। প্রতি সপ্তাহে হাট দুটি থেকে প্রায় ২৫০ টন পাটালি গুড় কেনাবেচা হয়। সেই সঙ্গে প্রায় ১০০ টনের বেশি কেনাবেচা হয় গুড়ের লালি।

বানেশ্বর বাজারের ব্যবসায়ী মিঠু ইসলাম বলেন, আমরা আমের মৌসুমে আম ও শীত মৌসুমে খেজুর গুড়ের ব্যবসা করি। গত কয়েক বছর আগে আমরা যে পরিমাণ খেজুর গুড় সরবরাহ করতাম, এখন তা অনেক কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন এ এলাকার উৎপাদিত প্রায় ১ টন গুড় কেনাবেচা হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। যারা অনলাইনে গুড় বিক্রি করে তারা আমাদের কাছ থেকে গুড় কিনে নিয়ে যায়।

আরেক ব্যবসায়ী সেলিম রেজা বলেন, আমরা প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার ট্রাকে বিভিন্ন স্থানে গুড় পাঠিয়ে থাকি। প্রতিকেজি খেজুরের গুড় বিক্রি করছি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। আমার গুড় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। সেখানকার আড়ৎদাররা তাদের গুড়ের চাহিদা জানালে আমরা সেভাবে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার বিদেশ থেকে আমরা গুড়ের অর্ডার পেয়েছি থার্ড পার্টির মাধ্যমে সেখানে গুড় পাঠাচ্ছি।

নুর হাসান নামের অনলাইনের গুড় ব্যবসায়ী বলেন, উপজেলার দু’শর বেশি যুবক অনলাইনে ব্যবসা করছেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন মসলামিশ্রিত গুড় অর্ডারে তৈরি করে সরবরাহ করছেন। আর এই গুড় তৈরিতে খরচ বেশি হয়। এর চাহিদাও বেশি। প্রতি কেজি গুড় বিক্রি করা হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। এতে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

বানেশ্বর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়ক গাজী সুলতান বলেন, বিগত বছরগুলোয় বাজারে অনেক বেশি খেজুর গুড় আমদানি হতো। সে তুলনায় এখন কেনাবেচা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর কারণ, এখন ক্রেতা-বিক্রেতারা অনেক সচেতন। প্রযুক্তির কালে বর্তমানে অনেকেই অনলাইনে গুড় কেনাবেচা করছেন। ফলে এখন শুধু গুড় নয়, বেশির ভাগ কৃষিপণ্য অনলাইনে বেচাকেনা হচ্ছে। এতে অনেক বেকার যুবক আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, খেজুর রস একটি অপ্রচলিত আবাদ। গ্রামীণ জনপদে রাস্তার পাশে এবং জমির আইলের ধারে অনেক গুড়চাষি খেজুর গাছ রোপণ করেন। শীত মৌসুমে প্রায় প্রতিটি গাছ হতে ২০-২৫ কেজি করে রস সংগ্রহ করা হয়। ১টি গাছ থেকে আহরিত রস দিয়ে কমপক্ষে ৮-১০ কেজি গুড় পাওয়া সম্ভব, যা ১টি পরিবারের মিষ্টির চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

তিনি আরও বলেন, আমরা রাজশাহী অঞ্চলে খেজুরের রসের উৎপাদন ও আবাদ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এছাড়া নিপা ভাইরাস প্রতিরোধের ব্যাপারেও গাছিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। সামান্য পরিচর্যা ও উদ্যোগে নিলেই খেজুরের রস ও গুড়ের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

আরএইচএফ/এসআর

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,