নদ-নদীতে চর, খাদ্যস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকায় এ বছর এখনো উল্লেখ্যযোগ্য অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের জলচর পরিযায়ী পাখিশুমারি দল গত নয় দিনের শুমারি শেষে এমন তথ্য জানিয়েছে।
বুধবার এই পাখিশুমারি শেষ হয়।
তাদের মতে, জেলার দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার ২১টি চরাঞ্চলে দেশের সর্বাধিক পাখি বিচরণ করে থাকে। এ বছর চরাঞ্চলে আর ওইসব পাখি দেখা যাচ্ছে না। পরিবেশের লবণাক্ততার প্রভাব ও প্রকৃতিক ভারসাম্যতার কারণেই অতিথি পাখি কম আসছে।
চরফ্যাশন উপজেলার সাগরকূলের চর ইউনিয়ন ঢালচর, পাতিলা ও কুকুরীসহ মনপুরা উপজেলার চর নিজাম, কলাতলির চর, ঢালচর, গোরিন্দার চর, চর পিয়াল পর্যন্ত দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার ২১টি চরে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ অতিথি পাখি এসে থাকে এই শীতের মৌসুমে।
পাখিশুমারি দলের প্রধান সায়েম ইউ চৌধুরী বলেন, নয় দিনে (০২ থেকে ১০ জানুয়ারি) তারা ভোলায় ৬২ প্রজাতির ৩৪ হাজার ৩১২টি পাখি গণনা করেছেন। ২০২৩ সালের তুলনায় ভোলায় এ বছর অনেক কম পাখি চোখে পড়েছে। ২০২৩ সালে ৬৫ প্রজাতির ৫৪ হাজার ১৮০টি পাখি গণনা করা হয়। অবশ্য ২০২২ সালে পাখি পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৩৩ হাজার। গত ৩৬ বছর (১৯৮৭-২০২৪) ধরে এ শুমারি হয়ে আসছে।
৩৬ বছরে পাখি অনেক কমেছে বলেও শুমারি দলের ভাষ্য। পাখিশুমারি দলটি ০২ জানুয়ারি ভোলার খেয়াঘাট থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া, ইলিশা, মেঘনা, মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর সাগর মোহনা, বুড়া গৌরাঙ্গ নদ, আবার তেঁতুলিয়া নদী হয়ে ১০ জানুয়ারি খেয়াঘাটে ফিরে আসে।
দলের সদস্যরা জানান, তারা নদী ও সাগর মোহনার মাঝে জেগে ওঠা ৪৬টি চর যেমন- চর মোহাম্মদ, কানিবগা, ভোলারচর, চর বৈরাগী, মধুপুর, নেয়ামতপুর, হুজুরের খাল, চর জহিরুদ্দিন, কাজীরচর, মৌলভীরচর, ঢালচর, নিঝুম দ্বীপ, দমারচর, জাহাজিয়া সূবর্ণচর, গাঙুরিয়ার চর, চর কুকরি-মুকরি, আন্ডার চর, সোনার চর, রোজিনার চর, চর শাহজালাল, ট্যাগরার চরসহ বিভিন্ন চরে নেমে ৬২ প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী জলচর পাখি গণনা করেছেন। এই দলে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের (বিবিসি) ভাইস প্রেসিডেন্ট সায়েম উল চৌধুরীর পাশাপাশি আরও ছিলেন বিবিসি'র সাবেক সাধারণ সম্পাদক, পাখি পর্যবেক্ষক ও পর্বতারোহী এম এ মুহিত; বিবিসির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মো ফয়সাল; পাখি বিশেষজ্ঞ নাজিম উদ্দিন খান প্রমুখ।
পাখি বিশেষজ্ঞ সায়েম উল চৌধুরী বলেন, আমরা ট্যাগরার চরে একটি দুর্লভ বৈকাল তিলি হাঁস দেখেছি। যা অনেক বছর আগে এ অঞ্চলে দেখা যায়। এ বছর গাঙগুয়ার চরে মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান নামক পাখি দেখা গেছে। এছাড়াও বিপন্ন বড় নট ও নিকট বিপন্ন দেশি গাঙচষা। সবচেয়ে বেশি পাখি দেখা গেছে- স্বর্ণদ্বীপে, যার পরিমাণ ছিল ৩১ প্রজাতির চার হাজার ৫৭টি। এরপর দমার চর, আন্ডার চর ও ট্যাগরার চরে। পাখিরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভোলার উপকূলে আসে খাবারের সন্ধানে। পরে তারা এখানে ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ফোটায়। শীত কমে গেলে যাওয়ার সময় বাচ্চা নিয়ে উড়ে যায়।
দলের পাখি বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের মধ্যে ভোলায় সবচেয়ে বেশি জলচর পরিযায়ী পাখি আসে, যা মোট পাখির প্রায় ৬০ ভাগ। এ অঞ্চলে অনেক বিপন্ন-মহাবিপন্ন পাখি দেখা যায়। এ বছর পাখি কম দেখা গেছে, এর মানে পাখি কম এসেছে, এমন নয়। হয়তো দলের চোখে পড়েনি। আগামী বছর বেশিও আসতে পারে। তবে মোটের ওপর ৩৬ বছরে পাখি কমেছে। কমে যাওয়ার কারণ পাখির বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পাখি গণনার উদ্দেশ্যের বিষয়ে সায়েম ইউ চৌধুরী বলেন, পাখি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শীতে এ দেশে আসা পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায়, পৃথিবীতে এদের সংখ্যা কত, কোন পাখির অবস্থান কোন অঞ্চলে, তা নিরুপণ করা যায়। বাংলাদেশে যদি পাখি আসা কমে যায়, তাহলে মনে করতে হবে এখানে সমস্যা আছে। সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এতে পাখিরও উপকার হবে, স্থানীয় মানুষের ও পরিবেশেরও উপকার হবে।
-এসএফ/এমএ