For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না উপকূলের অধিকাংশ নারী

Published : Tuesday, 2 January, 2024 at 12:59 PM Count : 236

রিনা বেগম(৫৫)। বড় ভাইয়ের পুলিশে চাকরির সুবাদে লেখাপড়া করেছেন খুলনা শহরে। বিয়ের পরে ১৯৯০ সালে চলে আসেন নিজ জেলা পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার মুরাদিয়া ইউনিয়নে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামী ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। পর পর তিন বার স্বামী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে তিনি নিজেও হয়ে উঠেন গৃহের অভ্যন্তরে আরেক চেয়ারম্যান। নিজের শিক্ষা জীবনের রাজনৈতিক দর্শন, ভালো লাগা, ভালোবাসা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় স্বামীর পছন্দের রাজনৈতিক দর্শনের কাছে। 

রিনা বেগম বলেন, তাঁর শ্বশুর ছিলেন মুরাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের দীর্ঘ বছরের চেয়ারম্যান। শ্বশুড়ের অবসরের পর স্বামী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৫, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন। কিন্তু কোনো নির্বাচনেই নিজের ইচ্ছায় ভোট প্রদান করতে পারেন নি। 

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তার শ্বশুর বাড়ির পরিবারটি রাজনৈতিক পরিবার। নির্বাচনে তাদের পরিবার শুধুমাত্র মুরাদিয়া ইউনিয়নের নয় পুরো দুমকী উপজেলায় একটা প্রভাব বিস্তার করে। তাই সেখানে নিজের পছন্দ থাকলেও ভোট দেয়ার সময় স্বামী, সন্তান এবং সংসারের ভালোর কথা চিন্তা করে স্বামী যে দলকে সমর্থন করেন সেই দলেই ভোট দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালে তার স্বামী মারা যাবার পর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ভোট দিতে যাননি। যারা কেন্দ্রে গিয়েছিল তাদের ভোট আগেই অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছিল বলে নিজের ভোট আর দিতে যেতে ইচ্ছে করেনি। 
এক ছেলে, এক মেয়ের মা রিনা বেগম বলেন, স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। এলাকার সাধারণ লোকজন স্বামীর জায়গায় তাকে নির্বাচন করতে বলেন। নিজে নির্বাচন না করলেও যারা প্রার্থী হন তাদের কোনো না কোনো প্রার্থী পরিবারের সন্তানসহ অন্য সদস্যদের দোয়া আর্শিবাদ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। পরিবারের বা বংশের সবার পছন্দের বাইরে গিয়ে তখন ভোট দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। 

তিনি বলেন, শুধুমাত্র তিনি একা ন্‌ তাদের পরিবারে এবং বংশে শতাধিক নারী একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন। তারা শুধু ভোটার- এটা ভুলে গিয়ে তাদের ভোট ক্যারি করার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগান পরিবারের পুরুষ সদস্যরা।

পটুয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালী উপজেলা রাঙ্গাবালী সদর ইউনিয়নের খালগোড়া এলাকার সুখি হাওলাদার (৪২)। নিজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। একাধিক মাছের ঘেরসহ রয়েছে কন্সট্রাকশন ব্যবসা। নিজের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি একই এলাকায়। 

তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ এমনকি সংসদ সদস্য নির্বাচনে বাড়ির ছেলেরা যে পক্ষে নির্বাচন করে তাদের নারীদের সবাই সে দিকে ভোট প্রদান করে থাকেন। সেটা যে পুরুষরা জোর করে ভোট দিতে বলে তা কিন্তু না। 

তিনি আরও বলেন, বাড়ির পুরুষরা যে ব্যক্তি বা দলকে সমর্থন করে নারীরা এমনিতেই সেই প্রার্থীকে ভোট দেন। যদি কোনো নারী স্বামীর পছন্দের প্রার্থীর বাইরে অন্য কোনো প্রার্থীকে ভোট দেন আর সেই তথ্য যদি সবাই জানতে পারেন তাহলে সেই নারীর সামাজিক মর্যাদা বলে আর কিছু থাকে না। পাড়াপড়শীদের তীর্ষক কথা শুনতে বাধ্য হন সেই নারীরা। এমনকি তার নামে নানা রকম অপবাদও দেয়া হয়ে থাকে। 

সুখি হাওলাদার বলেন, আমি নিজে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারী। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলে পড়াশুনা করছে। তারপরও বাড়ির পুরুষ সদস্যদের বাইরে গিয়ে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা দ্বন্দে পড়ি। মনে হয় বাবা, ভাই কিংবা স্বামী যেটা করছে সেটাই সঠিক। আবার তাদের পছন্দের বাইরে যদি অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে স্বামী, ভাই বা বাবার উপর রাজনৈতিক নির্যাতন হলে তা বন্ধ করার সুযোগ থাকে না। যার কারণে বাড়ির পুরুষরা ভালো থাকবেন এমন প্রত্যাশায়ই তাদের কথায় মূলত ভোট দিয়ে থাকি।

একই উপজেলার সাগরের কোল ঘেষা দেশের সর্ব দক্ষিণের চর মোন্তাজ ইউনিয়ন চরআন্ডা এলাকার বাসিন্দা সুফিয়া বেগম (৩২)। রাজনীতির কিছুই না জানা এই নারীর প্রধান চ্যালেঞ্জ শ্বশুর-শাশুড়ী, ছোট ছোট তিনটি ছেলে-মেয়ের তিন বেলার খাবার যোগান দেয়া। স্বামী-স্ত্রী দু'জনে মিলে তাই রাত-দিন চেষ্টা করেন সংসারের ভীত শক্ত করতে। 

তিনি বলেন, তার স্বামী সরকার দলীয় যুব সংগঠনের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার স্বামী যে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে সমর্থন করেছেন সে নির্বাচনে জয় লাভ করতে পারেনি। যে জয়লাভ করেছে তার বাড়ি সুফিয়া বেগমের বাড়ির পাশে। সে কারণেই স্বামীর অজান্তে তাকে তিনি ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্য, খেয়াঘাট, মাছের গদি সব কিছু অন্যপক্ষের লোকজন দখল করে নিয়ে যায়। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানালে তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেন নি যে তিনি তাকে ভোট দিয়েছিলেন। স্বামীকে সাবধান করার পরামর্শ দিয়ে বিষয়টি তিনি শেষ বারের মতো সমাধান করে দিয়েছিলেন।

সুফিয়া বেগম বলেন, সামনে এমপি নির্বাচন। এবার তো স্বামীর কথার বাইরে গিয়ে আর ভোট দিমু (দেব) না। নিজের ইচ্ছায় ভোট দিয়ে খালি খালি পরিবারের বিপদ ডাইক্কা আইন্না (ডেকে এনে) লাভ কি?

গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম বাশবুনিয়া এলাকার নারী উদ্যোক্তা লিপি বেগম (৩১)। স্বামী হাসান প্যাদার সহায়তায় এখন ১২টি গরুর একটি ডেইরি ফার্মের মালিক। 

তিনি বলেন, বড় মেয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নিয়ে স্বামীসহ সুখেই আছি। স্বামী রাজনীতি সচেতন মানুষ। আমাদের প্যাদা বাড়িতে প্রায় শতাধিক ভোটার যার অর্ধেক প্রায় নারী। তারা কম-বেশী সবাই বাড়ির পুরুষদের সিদ্ধান্তেই ভোট দিয়ে থাকেন। 

কেন পুরুষের সিদ্ধান্তে ভোট দেন এমন প্রশ্নের জবাবে লিপি বেগম বলেন, 'সমাজে চলাফেরা করে পুরুষ মানুষ। তারা তো দেশের ভাও (অবস্থা) ভালো বোঝে। এ কারণেই তাদের উপর ভরসা করেন তারা। তাছাড়া নির্বাচনে পুরুষদের বিরোধী পক্ষরা জয় লাভ করলে বাড়ির সকলকে তার জন্য মাশুল দিতে হয়। এ কারণেই তারা পুরুষদের সিদ্ধান্তে ভোট দিতে বাধ্য হন।

উপকূলীয় এলাকায় নারীদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা শুকতারা নারী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মাহফুজা হেলেন (৫৮) বলেন, দেশের প্রায় অর্ধেক নারীর মধ্যে শতকরা পাঁচ শতাংশ নারীও নিজের ইচ্ছায় বা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। যারা শিক্ষিত, কর্মজীবী, অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী তারাও বাড়ির পুরুষ সদস্যদের পছন্দে ভোট দিতে বাধ্য হন। নারীরা পুরুষের কথা না শুনলে তারা নির্যাতনের স্বীকার হন। এ নির্যাতন শারীরিক ও মানসিক উভয়ই হয়ে থাকে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা তৈরী করা। নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন ভোটারদের প্রতি যেন কোনো শক্তি প্রয়োগ না করা হয় সে বিষয়ে শক্ত নজরদারী প্রতিষ্ঠা করা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা আমুল পরিবর্তন আনা।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পটুয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানস কান্তি দত্ত (৬৫) বলেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫২ বছরেও আমরা একটা স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। আজকে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দাদাগিরি করতে সাহস দেখায় বিশ্ব মোড়লরা, যারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল। যে দেশে পুরুষরাই ৫০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে অন্যের কথায় ভোট দেয় সে দেশে নারীরা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কথায় ভোট দেবে এ আর দোষের কি? তবে নারী-পুরুষের ভোটের যে প্রতিফলন নির্বাচনী ফলাফলে আমরা দেখী সেখানে নারীর অংশগ্রহণ একেবারেই নগণ্য। আরপিওতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিধান থাকলেও দেশের সকল রাজনৈতিক দলই সেটা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও আশার কথা হচ্ছে মৌলবাদী চক্রের বিরোধীতার মুখেও রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে নারীদের আরও বেশী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত।

আগামীতে নারীরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পাবেন এমন দিনের প্রত্যাশা করেন মানস কান্তি দত্ত।

এ বিষয়ে নারী নেত্রী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেন বলেন, আমাদের উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পছন্দে ভোট দেয়ার বিষয়টি আসলে ট্র্যাডিশনাল। আমাদের দাদা, বাবা বা স্বামীরা যেটা চাইতেন পরিবারের নারীরা সেটা মেনে ভোট দিতো। বর্তমানে কিন্তু অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রজন্ম কিন্তু তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের বাইরে কাউকে ভোট দিতে চায় না। তাদের পুরুষরা বোঝাতে গেলে তারা উল্টো তাদের বুঝিয়ে দেয়। হয়তো প্রবীণ নারী যারা রয়েছেন তারা এখনো স্বামী বা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেন কিন্তু যারা নতুন ভোটার বা দ্বিতীয়বারের মতো ভোট দিচ্ছে তারা কিন্তু নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছে। মূল কথা হলো অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।

পটুয়াখালী জেলায় ১৪ লক্ষ নয় হাজার ৫৩০ জন ভোটার রয়েছেন। যার মধ্যে সাত লক্ষ ১২ হাজার ১৯২ জন পুরুষ এবং ছয় লক্ষ ৯৭ হাজার ৩২২ জন নারী ভোটর রয়েছেন। আগামী ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০৭টি কেন্দ্রে তিন হাজার ২০৪টি কক্ষে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ কবরেন।

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,