স্টেডিয়ামে ঢুকলে ক্ষণিকের জন্য মণি-মুক্তাকেও চোখের আড়াল করতে চাইলে দোষের কিছু হবে না। ক্রিকেট ভুবনে সাক্ষাৎ অষ্টম স্বর্গের! সৌন্দর্যের ডালা সাজানো বাগানেও যুদ্ধ হয় নাকি? যুদ্ধ নয়! মহাযুদ্ধ।
ধরা হচ্ছে ইতিহাসের সম্ভাব্য সেরা ক্রিকেট ফাইনাল। লড়াইয়ের মাঝে বিনোদন। টসের আগে আকাশে নয়টা যুদ্ধবিমানের শৈল্পিক কারুকাজ দেখবে মোতেরার নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম।
দু’দিন ধরে চলল বিমানের চোখ বাঁধানো মহড়া। প্রথম ইনিংস বিরতিতে গান, দুই ইনিংসের বিরতিতে বলিউডের প্রিতম গলফ কার্ট করে মাঠে ঢুকবেন, পেছনে থাকবে পাঁচশ সদস্যের ড্যান্স গ্রুপ! সময় মাত্র সাড়ে ১২ মিনিট। এক লাখ ৩২ হাজার সমর্থকের গগনবিদারী চিৎকারে তখন স্টেডিয়ামে শব্দ-বিস্ফোরণ হবে। যাদের জন্য এই মহাআয়োজন সেই রোহিত শর্মার হাতে স্বর্ণের ট্রফি উঠলে আলোয় জ্বলে উঠবে গোটা স্টেডিয়াম। রবিবাসরীয় ফাইনালে ভারতের স্বপ্ন ভেঙে দিতে প্রস্তুত প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া।
বিশ বছর পর আবার এই দু’দলের ফাইনাল। জোহানেসবার্গে হারা সেই ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে ভারত তেতে আছে। প্রতিপক্ষ যখন অস্ট্রেলিয়া তখন প্রশ্ন একটাই, প্রতিশোধের আগুন জ্বলবে তো! নাকি আরেকটি ২০০৩-এর হতাশা? আহমেদাবাদের এক লাখ ৩২ হাজার দর্শককে চুপ করিয়ে দিয়ে হাসতে চান প্যাট কামিন্স।
সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলনে এসে কামিন্স জানিয়ে গেলেন, ‘দর্শকদের চ্যালেঞ্জ আলিঙ্গন করে নিতেই হবে। ভীষণ রকমের একতরফা সমর্থন থাকবে। বিশাল সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার আনন্দ আর কিছুতেই নেই। আমাদের সেই লক্ষ্যই থাকবে। দিনটি আমরা কোনো আক্ষেপ না রেখেই শেষ করতে চাই।’
অনুশীলনের আগে প্যারা রাখতে চাননি, তাই আগে ভাগেই নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে গেছেন কামিন্স। এর পরই দুই অধিনায়ক যান গান্ধীনগরের দুই হাজার বছর পুরোনো আদালাজ স্টেপওয়েল বা রুদাবাই স্টেপওয়েলে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা এই ভবনের সামনেই হলো ট্রফি নিয়ে ফটোসেশন।
অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ মিশন হলে, ভারতের লড়াই হবে তৃতীয়বার জিতে ব্যবধান কমানের। ক্লাইভ লয়েড থেকে শুরু করে ইয়ান মরগান-সব বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ফাইনালে। একমাত্র পাকিস্তানের ইমরান খান আমন্ত্রণের সেই চিঠি পেয়েছেন কিনা জানা গেল না। তবে জেলে থেকেও মনে হয় সংবাদটা শুনেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়া রয়েছেন আরও অনেকে।
বিশ বছর আগে সেই ফাইনালে রিকি পন্টিংয়ের কাছে যখন হেরেছে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত, রোহিত শর্মার বয়স তখন ১৭! তখনকার সবকিছুই ভালো মনে আছে তার। ফাইনালের আগেরদিনও ঐচ্ছিক অনুশীলনে মাঠে এলেন ভারতের মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন। মুম্বাইয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর রোহিত শর্মাকে বার্তা দিয়েছেন কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার।
জানিয়েছেন, ফাইনালের কাজটা মোটেও সহজ হবে না। সেভাবেই এগোতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে রোহিত জানালেন, ‘টানা আট জয়ে ফাইনালে ওঠা অস্ট্রেলিয়াও জানে কিভাবে বড় মঞ্চে খেলতে হয়। আমরা যেভাবে নিজেদের কাজটা করেছি, সেভাবেই শেষ ম্যাচেও পরিকল্পনাগুলো কাজে লাগাতে চাই। আর মাত্র একটি ম্যাচ। বাইরে কী হচ্ছে, কেমন পরিবেশ, সবই বাইরে রেখেই মাঠে নামব।’
এরই মাঝে এই বিপুল আয়োজনেও কিছু সমালোচনা আছেই। ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন কিংবা ক্রিকেটের রাজধানী মুম্বাইয়ে ফাইনাল হলে আরও জাঁকজমকপূর্ণ হতো। প
শ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আগেরদিন বলেছেন, ভারতীয় জার্সির রং গেরুয়া কেন? অধিনায়ক স্টেডিয়ামের আসনগুলো নীল রঙের হলেও একমাত্র নরেন্দ্র মোদির নিচের স্তরের সব আসন অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি সবই গেরুয়া রঙের।
ভারত কোনো ম্যাচে হারেনি। টানা ১০ জয় পেয়ে ফাইনালে। অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা হয়েছিল টানা দুই হারে। এরপর তারাও কোনো ম্যাচ হারেনি। দুই ম্যাচ বেশি জয় পাওয়া ভারতকে তাই শুধুই এককভাবে এগিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। বড় টুর্নামেন্ট, ফাইনাল এগুলো তো অস্ট্রেলিয়ার অস্থিমজ্জায় ঢুকানো। বিশ্বকাপে নিজেকে শিখরে নিয়ে যাওয়ার বিরাট কোহলির কীর্তিতে অনেক কিছুই আড়াল হয়ে যাচ্ছে। রোহিত শর্মার খ্যাপাটে শুরু, শুবমান গিলের সূর্যোদয়ের আভাস, শ্রেয়াস আয়ারের পরিপক্বতা-সবশেষ প্রায় দয়া-দীক্ষায় সুযোগ পাওয়া মোহাম্মদ শামির বিধ্বংসী বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়গুলো থাকছে।
এক মাসেরও বেশি সময় আগে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ যে উইকেটে খেলা হয়েছিল সেই পিচেই ফাইনাল। তাই বলে লো-স্কোরিং ম্যাচ হবে এমনটা আলোচনায় নেই। এক মাস আগের চেয়ে আহমেদাবাদের কন্ডিশনেও পরিবর্তন এসেছে। শিশির কমলেও ঠান্ডা কিছুটা পড়েছে। ফাইনালের আগের পূর্বাভাসে বৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকাটাও বড় স্বস্তি।
২০১৯-এর দুই ফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে গত ৫ অক্টোবর শুরু হওয়া ১০ দলের মহাযজ্ঞের সমাপ্তিতে আজ শুধু ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। নানা ঘটন-অঘটন, রেকর্ড আর ‘টাইমড আউট’র মতো বিতর্কের সঙ্গী ৪৬ দিনের বিশ্বকাপের মধুর পরিসমাপ্তির অপেক্ষা।
এমবি