লাশ টেনে কেটেছে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস
Published : Saturday, 13 January, 2018 at 3:58 PM Count : 381
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন দ্বীপ জেলা ভোলায়ও পাকবাহিনী আসতে শুরু করে। এর আগেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ ভয়ে পারি জমায় ভারতে। বাকিরা আশপাশের শহরতলীতে আশ্রয় নিতে থাকেন।
লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সঙ্গে ঠাঁই মেলে শতাধিক দলিত পরিবারের। তাদের একজন মানিক লাল ডোম। প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিয়েও কাজে ফাঁকি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। অনেকটা বাধ্য করেই তাদের শহরে নিয়ে আসা হয়। এরপর হুকুম হয় লাশ বহন করা এবং মাটি দেয়া কাজ করার।
ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে বাঙালী মানেই মুক্তিযোদ্ধা। তাই তার সাফ কথা মুক্তিযোদ্ধার লাশ গর্তে ফেলে দেও। কাঁধে লাশ, চোখে জল সব মিলে একাকার হয়ে যায়। তবুও কাজ করতে হবে গর্ত খোঁড়া আর লাশ মাটিচাপা দেয়ার। এভাবেই লাশ টেনে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কাটে মানিক লালের।
কথা হয় শহরের বাপ্তা পৌরকলনীর বাসিন্দা মানিক লাল ডোমের সঙ্গে। তিনি জানান, নৌপথ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই গানবোট লঞ্চে পাকবাহিনী যাতায়াত শুরু করে। তাই সারাদেশের মত ভোলার লোকজন আতংক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিন কাটতে থাকে। প্রাণ ভয়ে প্রায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভোলার শহরতলীতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এ সময় ভোলায় ডোম কলোনী ছিল বর্তমান গাজিপুর রোডের মহিলা কলেজ মাঠে। সেখানে প্রায় দেড় শতাধিক প্রান্তিক সংখ্যালঘু বসবাস করতেন। পাকিস্তানি আর্মিদের ভয়ে তারাও পালাতে শুরু করেন। ধনিয়া ইউনিয়নের আলগী গ্রামে আশ্রয় নেয় তারা। খুব আদর যত্নেই কাটছিল তাদের। কিন্তু ১০ দিন যেতে না যেতেই পৌর চেয়ারম্যানের তলব আসে। ভয়ের কাছে কাজের রেহাই নেই। আবার সেই কলোনীতে ফিরে আসা। শান্তি কমিটির প্রধান ইলিয়াছ মাস্টারের নির্দেশে যুগীর ঘোল ওয়াবদায় ও নতুন বাজার টাউন হলে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন মানিক লাল, সুখ লাল, রমেশ লাল, বাবু লাল, মন্টু লাল, লক্ষ্মী রাণী, দুর্গা রানীসহ ১০ জন।
চারদিকে শুধু মৃত্যুর মিছিল আর হত্যাযজ্ঞ। ওয়াবদা পাকবাহিনীর ক্যাম্পের প্রতিদিনই ধরে আনা হতো নিরিহ বাঙালীদের। এরপর চলতো নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার। এক পর্যায়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সকাল হলেই ডাক পরতো মানিক লালের। ক্যাপ্টেন সাহেবের কড়া নির্দেশনা। “মুক্তি শালেকো লে যা, অর কুয়েমে ডাল দে মুন্না”। যেখানে হত্যা সেখানেই মানিক লালের তলব। সঙ্গীয়দের নিয়ে কাঁধে করে লাশ আনতে হবে।
শহরের পৌর শ্মশানের পাশে একটি গণকবর ছিল। ক্যাম্পের বাইরে যাদের হত্যা করা হতো তাদের লাশ ওই গণকবরেই রাখা হতো। আর ওয়াবদা ক্যাম্পের পেছনের জঙ্গলে ছিল অন্য একটি গণকবর। ক্যাম্পে এনে যাদের হত্যা করা হতো তাদের সেখানে মাটি চাপা দেয়া হতো কোন মতে। শত শত লাশ মানিক লাল কাঁধে করে দুই হাতে মাটি চাপা দিয়েছেন। ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সাহেব তাকে খুব ভালোবাসতেন। তাদের মতই পরিস্কার উর্ধু বলতে পারে মানিক লাল। তাই খুব সখ করে ক্যাপ্টেন সাহেব তাকে মুন্না বলে ডাকতেন। এর সুবাদে ক্যাম্পে ধরে আনা বেশ ক'জনের জীবন বাঁচিয়েছে মানিক লাল।
তাদের মধ্যে রায় মোহন করঞ্জাইয়ের ছেলে প্রশান্ত করঞ্জাই অন্যতম। তাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আসার পর যখন নির্যাতন শুরু করে পাক সেনারা। এ সময় রুটি আর কলা নিতে মানিক লালকে ভেতরে ডাকে ক্যাপ্টেন। তখন প্রশান্ত করঞ্জাইকে দেখে মানিক চিনতে পেরে “আপনি এখানে বাবু” এ কথা বলে ফেলেন। তখন ক্যাপ্টেন জানতে চায় ইছকো পেহেচানো (ওকে চিন তুমি)। তখন মানিক বলে চিনি স্যার। আচ্ছা আদমি। ক্যাপ্টেন বলে “শালে মুক্তি”। তখন মানিক লাল বলেন “নেহি স্যার এ আদমি মুক্তি নেহি হে”। এ কথা শুনে ক্যাপ্টেন বলে “মুন্না তুম কেহেতাহ এ আদমি মুক্তি নেহি” ওকে হাম মানলিয়া। এভাবেই প্রশান্ত করঞ্জাইকে পাক সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করতে কাজ করেন মানিক লাল।
কিন্তু সেই সারি সারি লাশের দৃশ্য মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন মানিক লাল। দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে এসব না বলা কথা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তি এসব কথা কখনো জানতে কেউ আসেনি। কখনও নিজেও কাউকে বলেনি এসব কথা। নয় মাস বাঙালী শহীদের লাশ টেনে কাটলেও তার কোন প্রতিদান চান না তিনি।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠির অধিকার আন্দোলন ভোলা জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দলিতদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এর কাজের স্বীকৃতি মিলেছে বেশ ক'বার আর তা নিয়েই শান্তিতে দিন কাটছে তার।
-এএম/এমএ