চলতি মৌসুমে আবারও হুইট ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে মেহেরপুরের গম ক্ষেত। ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কোন কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক।
জেলার বিভিন্ন মাঠেই এ রোগের দেখা দেওয়ায় ২০১৬ সালের পর নতুন করে আবারও কৃষকদের মাঝে ব্লাষ্ট আতংক দেখা দিয়েছে।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষি অফিসের পরামর্শ না নিয়ে ব্লাষ্ট প্রতিরোধী জাত বারি-৩৩ বপণ না করে নিজেদের ঘরে থাকা পুরাতন বীজ ও বাজার থেকে নিম্নমানের বীজ ক্রয় করে বপণ করায় আবারও হুইট ব্লাস্ট রোগের প্রাদূর্ভাব বেড়েছে।
মেহেরপুর কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মেহেরপুর জেলায় চলতি মৌসুমে ১২ হাজার পাঁচশ হেক্টর জমিতে এবার গমের আবাদ হয়েছে। যা গত বছর ছিল ১১ হাজার সাতশ হেক্টর। গত বছরে ব্লাষ্টের প্রকোপ একেবারেই শুন্যের কোটায় নেমেছিল। যার ফলে চলতি মৌসুমে গত মৌসুমের থেকে আটশ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ বেড়েছে।
এদিকে, জেলায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর গমের আবাদের সাড়ে ছয় হাজার হয়েছে গাংনী উপজেলায়। আর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বারি-৩৩ গমের বীজ যা ব্লাষ্ট প্রতিরোধী জাত বলে ইতোমধ্যে পরিক্ষীত। এই জাতের বীজ সংগ্রহ করে গম বপণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের পরামর্শ না নিয়ে জেলার অনেক কৃষক নিজেদের ঘরে থাকা পুরাতন বীজ বা বাজারের নিম্নমানের বীজ সংগ্রহ করে গম চাষ করে এখন বিপাকে পড়েছেন।
মেহেরপুরে চলতি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গম চাষ হয়েছে বারি-৩৩ এরপরও কৃষি বিভাগের পরামর্শ না নিয়ে চাষ হয়েছে বারি-২৪, ২৫, ২৬,২৮, ৩০ ও ৩২। কারো কারো ক্ষেত আবার অপরিশোধিত এবং আগাম বীজ বপণের কারণেও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে প্রথম মেহেরপুর জেলাসহ দেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের আটটি জেলায় হুইট ব্লাষ্ট রোগের দেখা মেলে। সেই সময়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আট জেলার গম ব্লাষ্টের কারণে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় থেকেই গম চাষে নিরুৎসাহিত করা হতো চাষিদের। তবে চলতি মৌসুমে ব্যাপক ভাবে না ছড়ালেও শতকরা ২০ ভাগ গম ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে।
এদিকে, ২০১৯ সালে বারি-৩৩ হুইট ব্লাষ্ট প্রতিরোধী এই জাতের গম চাষে সরকারি ভাবে সকলকে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি আগাম ও নামলা নয়। সঠিক সময়ে গম বপণ করার পরামর্শ ও পাশাপাশি সঠিক পরিচর্যার নিদের্শনা দেয়া হয় কৃষদের। কিন্তু অনেক কৃষকই
এ নিদের্শনার বাইরে গিয়ে গম চাষ করেছেন। ফলে হুইট ব্লাষ্টের আবারও আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়াজনিত কারণে গমের ব্লাষ্ট আবার বৃদ্ধি বা কম হতে পারে। চলতি মৌসুমে কয়েক বার বৃষ্টি হওয়ায় ব্লাষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে একজন কৃষক বারি-৩৩ গমেও ব্লাষ্ট রোগের অভিযোগ করেছেন। যদিও ভেজাল বীজ বলে কৃষি বিভাগ দাবি করেছে।
মেহেরপুরের কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, স্থানীয় সার-বীজ ব্যবসায়ী সালাম এন্টারপ্রাইজ থেকে বারি-৩৩ গমের বীজ সংগ্রহ করে এক বিঘা গম বপণ করি। পরিচর্যার শেষ পর্যায়ে এসে দেখি গমের শীষ সাদা হয়ে নষ্ট গেছে। গম না পাকতেই সাদা হয়ে যাওয়া রোগ। ২০১৬ সাল থেকে দেখা গেল দুই থেকে তিন বছর ভালো আবাদ হয়েছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে আবারও এ রোগের আক্রমণের শিকার হলাম। চলতি মৌসুমেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমার এক বিঘা জমির পুরো ক্ষেতই ব্লাষ্টের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ বীজ ব্যবসায়ী জানিয়েছিল বারি-৩৩ জাতের গমে ব্লাষ্ট লাগবে না।
আরেকজন কৃষক ফরমান আলী বলেন, গম শেষ পর্যায়ে শীষ সাদা হয়ে যাচ্ছে। আমরা ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছি। দেখি শেষ পর্যন্ত কি অবস্থা হয়?
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের গম চাষি রহিদুল ইসলাম বলেন, গাড়াডোব-সাহারবাটি মাঠে আমাদের প্রায় দেড় বিঘা জমিতে গম রয়েছে। শীষ পর্যন্ত আসতে গমের আবাদে বিভিন্ন ভাবে খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার আবার জমিটি কন্ট্রাক্ট নেয়া হয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। ফলে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হলেও ব্লাস্টের কারণে শেষ অবধি গম ক্ষেত সাদা হয়ে নষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থায় লোকসান থেকে বাঁচতে কৃষি বিভাগসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করছি।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ছয় হাজার পাঁচশ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ করা হয়েছে। আমাদের পরামর্শসহ বারি-৩৩ জাতের বীজ সরবারহ করা হয় এবং কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বার বার বলে দেয়া হয়েছে বারি-৩৩ জাতের গমের আবাদ করার জন্য। কিন্তু অনেক কৃষকই আমাদের পরামর্শ না নিয়ে স্থানীয় বাজারে নিম্নমানের বীজ বা নিজ ঘরে থাকা অপরিশোধিত বীজ বপণ করায় ব্লাষ্টের প্রভাব দেখা দিয়েছে। তবে প্রথমে অল্প ক্ষেতে দেখা দিলেও বর্তমানে আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে করে বারি-৩৩ ছাড়া সকল ক্ষেতই আক্রান্ত হতে পারে। বেশ কয়েকবার বৃষ্টি হওয়াতে চলতি মৌসুমে
আরও বেশি ক্ষেতে ছড়িয়ে পরে ব্লাষ্ট। এতে করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ বলেন, মেহেরপুর জেলার তিন উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১২ হাজার পাঁচশ হেক্টর গমের আবাদ হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ব্লাষ্টের কারণে জেলায় গমের আবাদে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়। কিন্তু গত দুই বছর আবারও গমের আবাদে সবুজ সংকেত দেয় কৃষি বিভাগ। যার ফলে চলতি মৌসুমে গমের আবাদ গত বছরের থেকে আটশ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা কৃষকদের সবসময়ে বারি ৩৩ গম বপণ করার পরমর্শ দিয়েছি। কিন্তু অনেক কৃষক বাজারের নিম্নমানের বীজ বা নিজেদের ঘরে থাকা অনেক পুরানো বীজ বপণ করায় ব্লাষ্টের দেখা দিয়েছে। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। বিভিন্ন মাঠের জমিতে ব্লাষ্টের বিরুদ্ধে আমাদের মাঠ কর্মীরা কাজ করেছে এবং প্রতিশেধকের পরামর্শ দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি ব্লাষ্ট আক্রমণে প্রথম যেমন ক্ষতি হয়েছে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
-এমআর/এমএ