রাজশাহী চিনিকলে বাজার দরের চেয়ে উৎপাদন খরচ চার গুণ বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছরে কয়েক শ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। অব্যাহত লোকসানের কারণে খুঁড়িয়ে চলছে ঐতিহ্যবাহী এ চিনিকল। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ৪০৫ টাকা ৬৮ পয়সা। কিন্তু সেই চিনি মাত্র ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরেই চিনিকলের লোকসান ৩৯১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
গত পাঁচ বছরে চিনিকলের উৎপাদন ও আয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ৯৩ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন। এতে ১০৮ কোটি পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ব্যয়ে চিনি পাওয়া যায় পাঁচ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। এই চিনি বিক্রি করা হয় মাত্র ২১ কোটি ৫১ লাখ আট হাজার টাকায়। এছাড়া চিটা গুড় বিক্রিসহ সব মিলিয়ে চিনিকলের মোট আয় ছিল ৩০ কোটি ৩১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ফলে এই অর্থবছরে লোকসান গুনতে হয় ৭৪ কোটি ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
এরপর ২০১৮-১৯ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় এক লাখ দুই হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন, যা থেকে চিনি উৎপাদন হয় ছয় হাজার ২১২ মেট্রিক টন। এই মৌসুমে ১৮ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় চিনি বিক্রিসহ মোট আয় হয় ২৫ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে উৎপাদন খরচ ১০৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ছিল ৮৩ কোটি ৭৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
২০১৯-২০ মৌসুমে এক লাখ ২৯ হাজার ২৫২ মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ে চিনি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ১৯ মেট্রিক টনে। এতে ১৭৫ কোটি ১২ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে চিনি বিক্রির ৮১ কোটি পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার টাকাসহ মোট আয় ছিল ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এই মৌসুমে লোকসান ছিল ৮৮ কোটি ৬১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
তবে ২০২০-২১ মৌসুমে মাত্র ৬৩ হাজার ৯৬৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয় রাজশাহী চিনিকলে। এতে চিনি উৎপাদন কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৬৪ দশমিক ৬০ মেট্রিক টনে। চিনি বিক্রির ২৫ কোটি আট লাখ ২৩ হাজার টাকাসহ এই অর্থবছরে আয় ছিল ৩৪ কোটি ৩১ লাখ ১২ হাজার টাকা। কিন্তু ১১৫ কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার টাকা খরচ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয় ৮১ কোটি ২১ লাখ ১১ হাজার টাকা।
২০২১-২২ মৌসুমে ২৪ হাজার তিন মেট্রিক টন আখ মাড়াই থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র এক হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। ফলে ২০ কোটি ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকার চিনি বিক্রিসহ মোট ২১ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আয়ের বিপরীতে খরচ হয় ৮৪ কোটি ৬২ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এতে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৬৩ কোটি ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে ২৬ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াই থেকে চিনি উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ ৮৩ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। মৌসুম শেষ না হওয়ায় এখনো আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে এই মৌসুমেও প্রতিষ্ঠানটির বড় লোকসান হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চিনিকলের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশি দামে চিনি উৎপাদন করে কম দামে বিক্রির ফলে বছর বছর বিপুল লোকসান গুনতে হওয়ায় দেশের ১৬টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি ২০২০ সালে বন্ধ করে দেয় সরকার। ওই সময় রাজশাহী চিনিকলও বন্ধ হওয়ার গুঞ্জন ওঠে। এতে চাষিদের সরবরাহের জন্য সার, বীজ, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষিজাত উপকরণগুলো রাজশাহী থেকে অন্য চিনিকলে পাঠানো হয়। এতে করে স্থানীয় চাষিরা হতাশ হয়ে তাদের জমি থেকে মুড়ি আখ (গোড়ার আখ গাছ) তুলে ফেলেন। জমিতে আখের বদলে অন্য ফসল আবাদে ঝুঁকে পড়েন তারা। আবার অনেকে জমিতে পুকুর খনন করেন। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ে রাজশাহী চিনিকলে। ফলে আখ সংকটের কারণে গত তিন বছরে চিনির উৎপাদন নেমে আসে তিন-চতুর্থাংশে। পাশাপাশি অব্যাহত লোকসানের কারণে খুঁড়িয়ে চলছে রাজশাহী চিনিকল।
রাজশাহীর কাঁটাখালী হাজরাপুকুর এলাকার আখ চাষি মাসুদ রানা বলেন, আমার দুই বিঘা জমিতে প্রতি বছরই আখ চাষ করি। কিন্তু দিন দিন সার, বীজ, কীটনাশকসহ শ্রমিক খরচ বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি আখের দাম। ফলে আমার মতো চাষিরা আখের বিকল্প হিসেবে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
রাজশাহী চিনিকল ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার বলেন, কৃষি প্রণোদনা হিসেবে আখ চাষিরা সার, কীটনাশক ও এসটিটি পদ্ধতিতে আখ আবাদের জন্য আখের মুড়ির জন্য ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। তারপরও আখের আবাদ ও উৎপাদন কম। মূলত, আখ থেকে মুনাফা কম পাওয়ায় চাষিরা অন্য লাভজনক চাষে ঝুঁকছেন। আর উৎপাদন খরচ যে হারে বাড়ছে, দাম সে হারে বাড়ছে না বলে লোকসানের মুখে পড়ছে প্রতিষ্ঠান।
রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প-কারখানাকে বন্ধের হাত থেকে বাঁচাতে সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার।
প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করতে বিকল্প উপায় জানিয়ে তিনি বলেন, আখ মাড়াই মৌসুম ছাড়া চিনিকলগুলো বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। সেই সময়ে আমের জুসসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, ডিস্টিলারি স্থাপন বা চিনিকলে কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে বাড়তি আয় হবে। প্রতিষ্ঠানটির স্থান, শ্রমিক ও সময় থাকায় লোকসান কমিয়ে চিনিকলকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
১৯৬২ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে এতে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।
-আরএইচ/এমএ