লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপে একই ক্লাবে খেলেন, ফ্রান্সের প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে, এই কথা অন্তত আজ রাতের জন্য দুজন ভুলে যেতে চাইবেন।
লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপে, আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের দুই সুপারস্টারই একবার করে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন, একজন পরাজিত হয়েছেন, আরেকজনের হাতে উঠেছে শিরোপা।
আজ রাতে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ও এমবাপের ফ্রান্স মুখোমুখি হবে কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে।
একজনের সামনে পরপর দুবার বিশ্বকাপ জিতে অমর হওয়ার সুযোগ। আরেকজনের সামনে ফুটবলে একমাত্র অপ্রাপ্তি দূর করার হয়তো এটাই শেষ সুযোগ।
লুইসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় শুরু হবে সেই ম্যাচ। প্রায় এক মাস ধরে যে ম্যাচের অপেক্ষায় ছিলেন বিশ্বব্যাপী ফুটবল সমর্থকরা - কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল।
দুই দলেই অনেক তারকা ফুটবলার আছেন, যারা ক্লাব পর্যায়েও নাম করা। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে আসছে দুজনের নাম, লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপে।
মেসি পারবেন এবার?
আট বছর আগে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং পত্রপত্রিকার পাতায় খুব দেখা গিয়েছিল।
লিওনেল মেসি বিশ্বকাপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, না পাওয়া বিশ্বকাপ। সেই না পাওয়ার গল্প এবারে শেষ করতে চাইবেন তিনি। সাথে বিশ্বের কোটি কোটি আর্জেন্টিনা ভক্তকূল যারা টেলিভিশনের সামনে, বড় স্ক্রিনের সামনে কিংবা নিতান্ত মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকবেন।
এই অপেক্ষা আজকের না, আট বছরেরও না, এই অপেক্ষা ৩৬ বছরের।
গত বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই লিখেছিলেন, 'মেসির হাতে উঠতে না পারাটা বিশ্বকাপেরই ব্যর্থতা'।
এবারও অনেকে লিখছেন, 'মেসি বিশ্বকাপ না জিতলে বিশ্বকাপ নিজেই অপূর্ণ থেকে যাবে'।
মেসি ব্যালন ডি অর জিতেছেন সাতবার। ক্লাব ফুটবলের এমন কোনও পুরস্কার বা শিরোপা নেই যেটা মেসি জেতেননি।
মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারে অপ্রাপ্তি এই একটাই, ফিফা বিশ্বকাপ। যেটা না জিতলে তিনি 'সর্বকালের সেরা'র যে মুকুট পরে থাকার কথা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। তার দেশেইতো একজন ম্যারাডোনা ছিলেন, বলা হয়ে থাকে তিনি ১৯৮৬ সালে ছিলেন দলের একমাত্র তারকা।
আর্জেন্টিনার সমর্থকরা, শিরোপার কমে সন্তুষ্ট হবেন না, মেসিও না। লিওনেল মেসির সব আছে শুধু বিশ্বকাপ বাদে। প্রতিপক্ষের বড় তারকা কিলিয়ান এমবাপের ক্যারিয়ার মাত্র আধা যুগ হবে, তার নামের পাশে একটা বিশ্বকাপ আছে, যিনি সেই বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারদের একজন ছিলেন। ছত্রিশ বছর বয়স্ক মেসির বিশ্বকাপ জেতার এটাই হয়তো শেষ সুযোগ।
এমবাপে কতটা ভয়ংকর হতে পারেন
কিলিয়ান এমবাপে কেন এতো আলোচিত তা অন্য কোনও দল জানুক আর নাই জানুক আর্জেন্টিনা জানে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে জানেন লিওনেল মেসি। যিনি গত চার বছরে জাতীয় দল ও ক্লাব পর্যায়ে এমবাপের দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হেরেছেন। এমবাপে সেসব ম্যাচে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
এমবাপের সামনে এখন সুযোগ মাত্র ২৩ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের।
মেসির মতো তারকাখ্যাতি বা সমর্থন এই বিশ্বকাপে না পেলেও এমবাপে খেলছেন মেসির মতোই। গোল করছেন, গোল করাচ্ছেন, মেসির চেয়ে একটি অ্যাসিস্ট কম তার শুধু।
দুই বিশ্বকাপ মিলিয়ে ইতোমধ্যে এমবাপে ৯ গোল করে ফেলেছেন। মেসি পাঁচ বিশ্বকাপে করেছেন ১১টি গোল। বিশ্বকাপ ফাইনালের ঠিক দুইদিন পরেই এমবাপের জন্মদিন। জন্মদিন উদযাপন কেমন হতে যাচ্ছে সেটা ঠিক হয়ে যাবে আজ রাতেই।
আর্জেন্টিনা কতটা মেসিনির্ভর
লম্বা সময় ধরে লিওনেল মেসির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো।
ফুটবলার মেসির যত সুনাম অধিনায়ক মেসির ঠিক ততটা সুনাম ছিল না। কিন্তু এই বিশ্বকাপে মেসি দুর্দান্ত অধিনায়কদের খাতায় নাম লেখিয়েছেন।
যিনি গোল করেছেন, গোল করিয়েছেন, রেফারির সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছেন, প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের শাসিয়েছেন।
অনেকেই এই সব ঘটনাকে ঠিক 'মেসিসুলভ' মানতে নারাজ হলেও বিবিসির ফুটবল কলামে স্পেনের বিখ্যাত লেখক গিলেম বালাগ বলেছেন, 'মাঠের বাইরে এসব ছোট ছোট খেলায় জয় আপনাকে শিরোপার কাছে নিয়ে আসতে পারে।'
সৌদি আরবের বিপক্ষে আলোচিত হারের পর আর্জেন্টিনার জন্য প্রতিটি ম্যাচই ছিল ফাইনাল। এবার শেষ ফাইনালে প্রতিপক্ষ ফ্রান্স।
আর্জেন্টিনা থেকে চল্লিশ হাজারের মতো লোক এসেছে কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে।আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে।কিন্তু ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম বলেছেন, 'আমরা এটা নিয়ে ভাবিনি'।
'ফ্রান্সের অনেকে চায় মেসি বিশ্বকাপ জিতুক'
একই দেশ পরপর দুবার বিশ্বকাপ জিতেছে, তাও প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ছয় দশক পর আবার পরপর দুবার বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ এসেছে কোন একটি দলের কাছে। আর সেটা হলে আগের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক এমবাপে এবারও নায়ক থাকবেন, আর সেটা থাকে ফুটবলের ইতিহাসে অমর করে দেবে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সে ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম বলেছেন, "আর্জেন্টিনার অনেক সমর্থন থাকবে, অনেকেই চাইবে আর্জেন্টিনা জিতুক, এমনকি ফ্রান্সের অনেকে চাইবেন মেসির হাতে কাপ উঠুক"।
"আমরা আমাদের জায়গা থেকে শতভাগ চেষ্টা করবো যাতে এটা না হয়"।
দিদিয়ের দেশম ১৯৯৮ সালে ফুটবলার হিসেবে এবং ২০১৮ সালে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। তবে ফ্রান্সের স্কোয়াডে কয়েকজন ফুটবলারের ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল, সেটা উড়িয়ে দিয়েছেন দেশম।
সবাই অনুশীলন করেছেন, এমন বার্তা দিয়েছেন তিনি। কারিম বেনজেমার ফাইনালে খেলার গুঞ্জনও উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
দেশম বলেছেন, "আমার ২৪ জন ফুটবলার আছে, যারা জীবন দিয়ে খেলবে এই ম্যাচ, আপনারা ইনজুরিতে থাকা ফুটবলারের কথা বলছেন। এসব কথা আমার ভালো লাগে না"।
আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স দুইদলই এর আগে দুইবার করে বিশ্বকাপ জিতেছেন একদল সুদূর অতীতে আরেকদল নিকট অতীতে। দুই দলের জন্য এখন জার্সিতে তৃতীয় তারকা বসানোর সুযোগ। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এনএন