২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় একমাত্র ছেলে মামুন মৃধাকে হারিয়ে আজও দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে পটুয়াখালীর দশমিনার মোতালেব মৃধা (৬৫) ও তার স্ত্রী মোর্শেদা বেগমের (৫৬)।
ওই দিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসমাবেশ স্থলে ঘাতকদের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় নিহত হন উপজেলার আলীপুরা ইউনিয়নের পশ্চিম আলীপুর গ্রামের মোতালেব মৃধার ছেলে ও রাজধানীর সরকারি কবি নজরুল কলেজের তৎকালীন দ্বাদশ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র মো. মামুন মৃধা।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ছেলে হত্যার বিচারের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও অবিলম্বে ওই রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন মামুনের শোকাহত বৃদ্ধ পিতা মাতা ও চার বোন মাহমুদা (৩২), ঝুমুর (৩০), রুনা (২৮) ও রুবিনা (২৬) সহ স্বজনরা।
উপজেলার ২ নং আলীপুরা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড পশ্চিম আলীপুর গ্রামে ১৯৮৮ সালের ০৭ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন মো. মামুন মৃধা। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। একই গ্রামের ৬ নং পশ্চিম আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পশ্চিম আলীপুরা বি বি রায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন তিনি। সেখান থেকে ২০০৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ ২.৯৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে একই বছর তিনি রাজধানীর সরকারি কবি নজরুল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মামুন শৈশব কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আওয়ামী লীগকে ভালোবাসতেন। তিনি দীর্ঘদিন পশ্চিম আলীপুর বি বি রায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। রাজধানীর সরকারি কবি নজরুল কলেজেও তিনি ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সমর্থক ছিলেন।
বুক ফাটা আর্তনাদে কান্না জড়িত কন্ঠে অসুস্থ মোতালেব মৃধা জানান, একমাত্র ছেলে মামুন মৃধাকে নিয়ে তিনি পুরান ঢাকার কসাইটুলি এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। তিনি একটি স্ব-মিলে শ্রমিকের কাজ করে ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। রাজধানী শহরের যেখানেই শেখ হাসিনার সমাবেশ হতো সেখানেই প্রাণের টানে ছুটে যেত আমার মামুন। ওই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে যায় মামুন। আর ফিরে আসে না। রাতে আমার চাচাতো ভাই আনোয়ারের মাধ্যমে খবর পাই সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। পরে মামুনের সন্ধান না পেয়ে আমার চাচা শাহ আলম মৃধাসহ স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে আমার বুকের ধন মামুনের লাশ শনাক্ত করে। পরে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরি।
মামুনের অসুস্থ্য বৃদ্ধা মা মোর্শেদা বেগম জানান, ২১ অগাস্ট ঘাতকদের ভয়াবহ সন্ত্রাসী গ্রেনেড হামলায় আমার একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে আমাদের স্বপ্ন। যতদিন পর্যন্ত বিচারের রায় কার্যকর না হবে ততদিন পর্যন্ত আমার বুকের মানিক মামুনসহ নিহত অন্যদের আত্মা শান্তি পাবে না। আমি মৃত্যুর আগে যেন এই বিচারের রায় কার্যকর দেখে যেতে পারি।
মামুনের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। ২০১৪ সালে ১০ লাখ টাকার আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। যা পটুয়াখালীর পোস্ট অফিসে জমা আছে। ওই টাকার মুনাফায় যা আসে তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে আর্থিক সহায়তা করেছেন। আমরা শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
জানা যায়, মামুনের অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা মাতা বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে আছেন। কিছুদিন আগে তার বৃদ্ধা মায়ের এক চোখে অপারেশন হয়েছে। অপরটিও অপারেশন করতে হবে। টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারেনি।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মামুন মৃধার চার বোনের মধ্যে রুনা (২৭) উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ও রুবিনা (২৫) স্নাতক পাশ করেছেন। তাদের দু'জনের কর্মসংস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মী, স্থানীয় ও স্বজনরা। বর্তমানে রুবিনা অর্থের অভাবে বাকপ্রতিবন্ধী একমাত্র কন্যা আয়শাকে নিয়ে পিত্রালয়ে থাকেন।
আলীপুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. কাদের মুন্সী জানান, আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সব সময়ই মামুন মৃধার পরিবারের পাশে থাকি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রবিউল হোসেন জানান, গ্রেনেড হামলায় নিহত মামুন মৃধার কবরস্থান সংস্কারের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য টিআর প্রকল্প থেকে তিন লক্ষ টাকার আর্থিক বরাদ্দ করেছেন। যা দ্বারা ইতোমধ্যে মামুন মৃধার কবরস্থান সংস্কার করা হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আজীজ জানান, মামুন মৃধার অসহায় পরিবারের প্রতি আমি সর্বাত্মক খোঁজখবর রাখি। আমি অতিদ্রুত বিচারের রায় কার্যকরের জোর দাবি জানাচ্ছি।
-এসটি/এমএ