For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

চেক জালিয়াতিতে পৌরসভার টাকা গায়েব করা চাঁন পেলেন নৌকার মনোনয়ন

Published : Saturday, 14 May, 2022 at 4:17 PM Count : 155

চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ৯ লাখ টাকার বিপরীতে ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা ঝিনাইদহ পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনয়ন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাগলাকানাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের ২৭ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভার ২৯৬ নম্বর স্মারকে সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিণ্টু সিনিয়র সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন। সেখানে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ৯ লাখ টাকার বিপরীতে ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয় ঝিনাইদহ পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁনের  বিরুদ্ধে। স্থানীয় সরকার বিভাগের তদন্তে চাঁনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে। এতকিছুর পরও অর্থ তছরুপে অভিযুক্ত সেই আসাদুজ্জামান চাঁনকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের দাবি, আসাদুজ্জামান চাঁন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি কখনও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগ করেননি। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা দলীয় পরিচয়ে চাঁনকে চেনেন না। তার মতো বিতর্কিত কর্মকর্তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হতাশাজনক। এতে ত্যাগী নেতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।

যেভাবে নৌকার মনোনয়ন: পাগলাকানাই ইউনিয়ন পরিষদটি মরমি কবি পাগলাকানাইয়ের জন্মস্থান হওয়ায় এটি দেশের ঐতিহ্যবাহী একটি ইউনিয়ন। এটি ঝিনাইদহ শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকাও। ওই ইউনিয়ন পরিষদে এতদিন বিএনপিপন্থী চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এই অবস্থায় দলীয় লোক জেতাতে বিকল্প খুঁজছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিজ্ঞাপন

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ— রাজনৈতিক শক্তি না থাকলেও এলাকায় এরইমধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছেন পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন। পাগলাকানাইয়ের বেড়বাড়ি গ্রামে তার বাড়ি। সরকারি চাকরির সুবাধে করেছেন বাড়ি, কিনেছেন নামে-বেনামে জমিও। অর্থশক্তি থাকার কারণেই তাকেই ‘যোগ্য প্রার্থী’ হিসেবে বেছে নেয় আওয়ামী লীগের একাংশ। প্রার্থীদের তালিকায় তার নামটি রাখেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু।

আসাদুজ্জামানের চাঁনের বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুললেও কয়েকমাসের ব্যবধানে তিনিই আবার তার মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে সুপারিশ পাঠান।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদের বাড়ি পাগলাকানাই ইউনিয়নে। সে বিষয়ে দলীয় আনুগত্যশীল জনপ্রতিনিধি বাছাই করতে তিনিও পছন্দ করেন চাঁনকে। উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের জন্য সুপারিশপত্র পাঠানো হয় জেলা আওয়ামী লীগের কাছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশপত্র অগ্রগামী করে চিঠি দেন।

এ বিষয়ে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ শহিদুল ইসলাম হিরন বলেন, ‘তার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশীদ। তিনি কী বুঝে তাকে পছন্দ করলেন মাথায় ঢুকছে না। তার বাড়িও পাগলাকানাইয়ে।’

তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুপারিশপত্রে সই করেছি। এ ছাড়া আমার কোনো বিকল্প ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছিলেন, বিরোধে যাওয়ার দরকার নেই। চারজনের তালিকায় চাঁনের নাম থাকলেও আমি তাতে বাধ্য হয়ে সই করেছি।’

শহিদুল ইসলাম হিরন দাবি করেন ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাইকেও আমরা সার্বিক বিষয় জানিয়েছিলাম। তিনিও চাননি এরকম প্রার্থীর নাম মনোনয়নের সুপারিশে আসুক। তিনিও আবদুর রশীদকে বলেছিলেন, তালিকায় যেন চাঁনের নাম না থাকে।

হিরনের দাবি, এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আর্থিক লেনদেনের যোগসূত্র থাকতে পারেন।

এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে চারজন প্রার্থীর নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। আবু সাঈদ বিশ্বাস, আসাদুজ্জামান চাঁন, আছাদুজ্জামান সুজন, আতিক এই চারজনের নাম দিয়েছিলাম। সাধারণত এক নম্বর প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এবার এটির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগ চারজন প্রার্থীর না, নাম জেলা আওয়ামী লীগের কাছে দিয়েছিল। এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কিছু জানার থাকলে আপনি জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির কাছে জানতে চাইতে পারেন।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, ‘মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বোর্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোর্ড যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সে ব্যাপারে আমাদের কোনো মন্তব্য করা সাজে না।’

যার নামে অভিযোগ তাকেই সুপারিশ সাইদুল করিম মিন্টুর: আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ২৭ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভার ২৯৬ নম্বর স্মারকে সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিণ্টু সিনিয়র সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন।

ওই পত্রে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ওরফে চাঁদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ তোলেন মেয়র। শুধু তাই চাঁনকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়ারও অনুরোধ জানান মিন্টু।

সাইদুল করিম মিন্টু অভিযোগ করে বলেন, ‘পৌরসভার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন উত্তোলন করেন। এর মধ্যে ২৮ লাখ টাকা চেক জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি চেকের মাধ্যমে বিপুল অংকের ওই টাকা স্থানীয় জনতা, সোনালীসহ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। অথচ পৌরসভার ক্যাশ বইয়ে মাত্র ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকা দেখানো হয়েছে।’

পৌর মেয়রের অভিযোগ পাওয়ার পর তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পড়ে স্থানীয় সরকার বিষয়ক উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলামের কাঁধে। ওই তদন্তে আসাদুজ্জামান চাঁনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। শিগগিরই এই তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ার কথা।

পৌরসভার যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই কর্মকর্তাকেই আবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সুপারিশপত্র অগ্রগামী করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। তবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও সাইদুল করিম মিন্টুর কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তিনি আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন। এখন সম্পর্ক ভালো হয়েছে। এ ছাড়া আসাদুজ্জামান চাঁন দোষী প্রমাণিত হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে তাই মিন্টু তাকে রক্ষা করতে চাইছেন।

আসাদুজ্জামান চাঁন এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাইদুল করিম মিন্টু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন সত্য। তবে দুষ্কৃতিকারীদের চক্রান্তে এটি হয়েছিল। তদন্ত অফিসারের কাছে সাইদুল করিম মিন্টু জানিয়েছেন, তিনি পৌরসভার মেয়র থাকাকালে অনেক জায়গায় সই করতে হয়েছে। কোনো একভাবে এই অভিযোগপত্রেও তাকে সই করতে হয়েছে। অভিযোগে তার সই থাকলেও, অভিযোগ তার তরফ থেকে দেওয়া না।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ হাকিম বলেন, ‘চাঁনের জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে তা সাধারণ সম্পাদক করেছেন। তিনি কোনো বিরোধে না গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশটি অগ্রগামী করেছেন। এখানে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আমি সম্পৃক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই।’

সুপারিশ অগ্রগামী করার বেলায় জেলা আওয়ামী লীগ আরও যাচাই-বাছাই করতে পারত কি না জানতে চাইলে এম এ হাকিম বলেন, ‘অবশ্যই সেটি করা যেত। কিন্তু সাইদুল করিম মিন্টু হয়ত তা করতে চাননি।’

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ইয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। দোষ শুধু আসাদুজ্জামান চাঁনের একা নেই। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব।’ এর বেশি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি স্থানীয় সরকার বিভাগের এই কর্মকর্তা।

তবে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন। তিনি বলেন, ‘পৌরসভার যে কোনো চেক থাকে হিসাব থাকায়। সেখানে সই করেন মেয়র ও সচিব। আমি তো চেক ডিল করি না। আমার কাছে চেক এলে সই থাকবে চেকের পেছনে। কে কত টাকা, কোথা থেকে কবে তুলল সে বিষয়ে তো আমি কিছু বলতে পারব না।’

মনোনয়ন পাওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। ওই ইউনিয়নে এতদিন বিএনপি জিতে আসছিল। ইউনিয়নের মানুষ আমাকে চাইছেন। সবাই ভেবেছেন আমি পাস করব, আশা করি নেত্রীর চাওয়া আমি পূরণ করতে পারব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। মিছিল-মিটিংয়ে আমি কখনও থাকিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ করেছি।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসনের এমপি আবদুল হাই বলেন, ‘আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে তা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আরও ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিতে হবে। আপনারা (সাংবাদিক) ভালো বলতে পারবেন।’

এসআর

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,