For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

অনুমোদনহীন গোডাউনে দাহ্য পদার্থের কাজেও ছিল না অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা

Published : Thursday, 24 February, 2022 at 11:00 PM Count : 113

সাভারেআশুলিয়ায় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই অনুমোদনহীন ভাবে জুতার কারখানা পরিচালনা করার কারণেই আগুনে পুড়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীদের।

যদিও এটাকে স্থানীয়রা গোডাউন নামেই চিনতো। কিন্তু টাকার লোভে ছোট্ট পরিসরে স্থাপিত কারখানাটিতে কোন ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছাড়াই বেশির ভাগ শিশু শ্রমিক নিয়ে দাহ্য পদার্থ দিয়ে কাজ করানো হতো। এখানে কর্মরত শ্রমিকদেরকে শ্রম আইন অনুযায়ী বেতন-ভাতা কিংবা অন্য কোন সুবিধাও প্রদান করা হত না বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতারা। 

সর্বোপরি ইউনি ওয়ার্ল্ড ওয়ার লিমিটেড নামক জুতা তৈরির কারখানার মালিক মিজানুর রহমানের সেচ্ছাচারিতার কারণেই তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। 

এ ঘটনায় টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানসহ ভুক্তভোগী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এছাড়া শ্রমিক নিহতের ঘটনায় কারখানার মালিকসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে আশুলিয়া ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু সড়কের বৈদ্য মন্দির সংলগ্ন ইউনি ওয়ার্ল্ড ওয়ার লিমিটেড নামক জুতা তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনে কারখানাটিতে শ্রমিক মৃত্যুর খবরে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসুক লোকজন এক নজরে পুড়ে যাওয়া কারখানাটি দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় করছেন। কারখানার চারপাশ দিয়ে ঘুরে যে দিকেই ফাঁকা পাচ্ছে সে দিক দিয়েই উকি দিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টার করছে। 

কারখার মূল ফটকের সামনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বেশ কিছু কেমিক্যালের ড্রাম। আগুনের তীব্রতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যা প্রায় ২০ ফিট রাস্তা পার হয়ে পার্শ্ববর্তী গরুর খামারের সেডে লেগে যাচ্ছিলো। সেডের সঙ্গে থাকা কাঠাল গাছটির ডালপালাও আগুনে পুড়ে গেছে।

কারখানার মূল ফটক দিকে ঢুকতেই হাতের বা পাশে দেখা গেছে ইলেকট্রিক লাইনের যাবতীয় সরঞ্জামাদির ডিবি বক্স। কারখানাটির নীচতলায় এবং দোতলায় থাকা বিভিন্ন ধরনের মেশিনারীজ পুড়ে গেলেও অক্ষত রয়েছে কেমিক্যাল ও জুতার গাম ভর্তি টিনগুলো। ভেতরে একপাশে এখনও পুড়ে যাওয়া জুতার সোলের স্তুপ থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। তবে সেখান থেকে আগুন যাতে আর ছড়াতে না পারে সে জন্য নিজ দায়িত্বে বাসা থেকে পাইপ দিয়ে পানি এনে ঢালছেন প্রতিবেশী বাড়ির বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া। 

আগুনের হাত থেকে বেঁচে ফেরা নারী শ্রমিক রেশমা আক্তার বলেন, নীচতলায় থাকা বড় মেশিন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ সময় আমি বের হওয়ার জন্য সিড়ির সামনে এলেও ধোয়ার কারণে কিছু দেখতে পারছিলাম না। তারপর কোনমতে জানালা খুঁজে পেয়ে সেটা খুলে শ্বাস নেই। এরপর চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন জানালা ভেঙ্গে আমাকে বেড় করে। কারখানাটিতে শতাধিক শ্রমিক কাজ করলেও বেশির ভাগই শিশু শ্রমিক।

অপর নারী শ্রমিক রিনা আক্তার বলেন, আমার পেছনের মেশিনেই আগুন লাগে। কিন্তু আমি বের হতে গিয়েই দেখি গেট বন্ধ। পড়ে জানতে পারি দারোয়ান বাইরে থেকে তালা দিয়ে চা খেতে গিয়েছিলো। আমি কোনমতে স্থানীয়দের সহায়তায় জানালা দিয়ে বের হতে পারলেও আমার পেছনে থাকা কয়েকজন টয়লেটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা সেখানেই পুরে মারা গেছে।

কারখানার সামনে স্বামীর খোঁজে আসা কারখানাটির অপারেটর মনিরা বেগম বলেন, আমার স্বামী সুমন মিয়া এবং আমি একসঙ্গেই কারখানাটিতে কাজ করতাম। আগুন লাগার সময় আমি দোতলায় কাজ করছিলাম এবং আমার স্বামী নীচতলায় কাজ করছিলো। গতকাল ৫টায় কারখানা ছুটির কথা থাকলেও ছুটি না হওয়ায় পুনরায় কাজে যোগ দেই। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পাই আগুন। কিন্তু এতোবড় আগুন লাগলেও কেউ চিৎকার করেনি। আমি স্বামীর খোঁজে বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেও কোথাও তাকে পাচ্ছি না।

আগুনে নিহত তিন শ্রমিকের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- টাঙ্গাইলের সদর থানা এলাকার আনুহাল্লা গ্রামের মোবারকের ছোট মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (১৪), খুলনার পাইকগাছা থানার খুড়িয়া গ্রামের ঝালমুড়ি বিক্রেতা হানিফের স্ত্রী শাহানারা বেগম (৪০) ও অপরজনের নাম মো. রুবেল মিয়া (২৮)।

নিহত শাহানারা বেগমের ছেলে সবুজ বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় বড় বোনকে হারিয়েছি। এরপর বেশ কিছু দিন গ্রামে গিয়ে থাকলেও গত দুই বছর আগে আবারও জীবিকার তাগিদে মায়ের সঙ্গে আশুলিয়ায় আসি। আমার মা জুতার কারখানায় কাজ করতো এবং বাবা ঝালমুড়ি বিক্রি করতো। তাতে খুব ভালো ভাবেই চলছিলো সংসার। কিন্তু হঠাৎ কারখানায় লাগা আগুনে আমার সব পুড়ে শেষ হয়ে গেলো। মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এখন আমি কিভাবে কি করবো, কাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখবো। অর্থলোভী কারখানা মালিকদের কারণেই আমরা গরিব মানুষরা প্রতিনিয়ত সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছি। আমি যে কারখানা কাজ করতে গিয়ে মারা যাব না তার কোন গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবেন? 

তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করছি। আগুন লাগার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ইউনি ওয়ার্ল্ড ওয়ার লিমিটেড নামক জুতা তৈরির কারখানাটি কোন ধরনের অনুমোদন না নিয়েই শ্রম আইন উপেক্ষা করে শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতো। এ কারখানাটিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা তো দূরের কথা কোন ট্রেড লাইসেন্সও নাই। এলাকার লোকজন এটাকে গোডাউন হিসেবে জানলেও এটার ভেতরে অল্প জায়াগায় গাদাগাদি করে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হতো। আগুন লাগার ঘটনায় তিন শ্রমিক মারা যাওয়ার বিষয়টি কলকারখানা অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোন ভাবেই এর দায় এড়াতে পারেনা। তারা যদি ঠিক ভাবে মনিটরিং করতো তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতো না। আমরা অবিলম্বে কারখানার লোভী মালিক শ্রমিক হত্যাকারী মিজানুর রহমানসহ জড়িতদের গ্রেফতার ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে কারখানার সামনে মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করবো।

আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন মাতবর বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানাটি আমাদের কাছ থেকে কোন ট্রেড লাইসেন্স নেয়নি। কাঠগড়া এলাকার আজমত গ্রুপ নামে একটি কারখানা গত পাঁচ বছরে ট্রেড লাইসেন্স নেয়নি। তাহলে তারা কিভাবে বায়ার মেইন্টেইন করে জানিনা। একবার ট্রেড লাইসেন্সের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আমাদেরকে চিঠি দিলে উল্টো মালিকপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে উকিল নোটিশ পাঠায়। আশুলিয়ায় প্রায় আটশ কারখানা থাকলেও সরকারি ভাবে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমরা তাদেরকে চাপ দিতে পারি না।

আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুদিপ কোমার গোপ বলেন, জুতার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় কারখানার মালিকসহ দু'জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত অনেকের নাম রয়েছে। এ ঘটনায় আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। নিহতদের প্রত্যেককে দাফনের জন্য সরকারি ভাবে ২৫ হাজার করে টাকা দেয়া হবে। আমরা টাকা নিয়ে দেয়ার জন্য বসে আছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ আসেনি। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব কিংবা আমার অফিসে সরাসরি যোগাযোগ করে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে টাকা দাবি করলেই তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে। 

-ওএফ/এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,