For English Version
রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
হোম

বৈরী আবহাওয়ায় সাগরের অচেনা আচরণে উপকূলীয় জীবন বিপর্যস্ত

Published : Tuesday, 27 October, 2020 at 12:17 PM Count : 208

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মুজিবনগর। সমুদ্র উপকূলবর্তী এই দ্বীপ ইউনিয়নের চর মনোহর গ্রামে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় কান্নার শব্দ। বুক ফাটা আহাজারি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি গেলেও, একই দৃশ্য। শোকের ছায়া গ্রামজুড়ে।

চলতি বছরের অগাস্ট মাসে এই গ্রামের ৭ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। সকলেই প্রতিবেশী এবং একে অপরের আত্মীয়।  নিখোঁজ এই মানুষগুলোর স্বজনদের আহাজারিতে গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে আছে।

অগাস্ট মাসে সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে ১৭ জন জেলের মধ্যে ১০ জন জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলেন। বাকিরা ফেরেননি। সে দিন প্রবল ঝড়ের মুখে তুফানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে জীবিত ফিরে আসাদের মধ্যে আবদুল মোতালেব ফরাজী একজন।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'সমুদ্রের অবস্থা খারাপ দেখে আমরা কিনারের দিকে ফিরছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে আসা প্রবল ঢেউয়ে ট্রলার উল্টে যায়। ট্রলার ধরে কয়েকজন বাঁচার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ট্রলার থেকে যারা ছিটকে গেছে তারা আর ফেরেনি।
ফিরে না আসা আলমগীর হোসেন (৩৭), জাকির হোসেন (৩৫), সামসুদ্দিন (৪৮), আবু কালাম ফরাজী (৪২), বাবুল হোসেন (৪০), আবু কালাম ফরাজী (৪৫) ও আলী আজগর (২৫)- প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে দেখি কান্নার রোল। এখনও কেউ স্বাভাবিক হতে পারেননি।

নিখোঁজ জেলে জাকির হোসেনের বাড়িতে পা রাখতেই ঘরের ভেতর থেকে বিলাপ কানে আসে। ঘরে ঢুকে দেখি মুখ চেপে কাঁদছেন অনেকেই। জাকিরের রেখে যাওয়া ৩ লাখ টাকা ঋণ কিভাবে শোধ করবেন স্ত্রী হাসিনা জানেন না। তিন তিনটি কন্যা সন্তান তাদের। বড় মেয়ে কমলা বিয়ের যোগ্য। অন্য দু’জনের মধ্যে লামিয়া পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সিনথিয়ার বয়স মাত্র ৪ বছর। হাসিনা বেগমের এলোমেলো নড়বড়ে দুই কক্ষের ঘর। এরই মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই।

‘বাবা কী বলেছিল যাওয়া সময়?’ লামিয়াকে প্রশ্ন করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কান্নার শব্দে স্পষ্ট শোনা যায়নি তার জবাব।

নজির আহম্মেদের বাড়ি ‘মাঝি বাড়ি’ বললে সবাই চেনে। এই মাঝির ৮ ছেলের সবার পেশা মাছ ধরা। সুন্দর সাজানো বাড়ি। বাড়ির প্রবেশ পথেই নিখোঁজ জেলে আলমগীর হোসেনের ঘর। বাড়িতে ঢুকতেই আলমগীরের ৬ বছরের ছেলে তামিম ও ১১ বছরের মেয়ে লিজা আমার মুখের দিকে তাকায়। ছোট্ট চোখে-মুখে স্পষ্ট কৌতূহল। হয়তো শুনেছে ওর বাবার খবর নিয়ে এসেছে কেউ। ঘরের ভেতর থেকে আলমগীরের স্ত্রী রিফা বেগমের আহাজারি কানে আসে। আলমগীরের ঋণ প্রায় ৬০ হাজার টাকা। সে ছাড়া এই পরিবারের আর কেউ কর্মক্ষম নয়।

নিখোঁজ জেলে সামসুদ্দিনের বাড়ি চর মনোহর গ্রামে বেড়িবাঁধের ঢালে। সরকারি জমিতে বসবাস করছেন বহু বছর। একমাত্র জীবিকা ছিল মাছ ধরা। সেই মাছ ধরাই তার কাল হলো। ৩ সন্তান নিয়ে স্ত্রী সুরমা বেগম এখন চরম বিপাকে।

খানিক দূরে বেড়িবাঁধের পাশের ছোট্ট একটি ঘরে থাকতেন আরেকজন নিখোঁজ জেলে আবু কালাম ফরাজী। ঘরে ঢুকতেই বাড়ি ভরে গেল লোকজনে। বহুজনের অনেক কথার ভিড়ে ঘরের ভেতর থেকে কালামের স্ত্রী রোকেয়া বেগমের আহাজারি শুনতে পাওয়া গেল। আবু কালাম ফরাজী রেখে গেছেন ৭ ছেলে-মেয়ে। বেশ বড় সংসার।

সবচেয়ে ছোট সন্তানটির নাম সুমাইয়া। বয়স মাত্র ৪ বছর। সে অপেক্ষায় থাকে বাবা একদিন ফিরবে। বাবা তার জন্য অনেক মজা নিয়েই ফিরবে। কালাম ফরাজীর স্ত্রী মুক্তা বেগম কোন কথাই বলতে পারলেন না।

কালামের বড় ভাই শহীদ কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। বললেন, ‘ভাইকে বলেছিলাম যাইস না। ভাই শোনে নাই।’ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে বিপাকে মুক্তা বেগম। 

একই বাড়ির প্রবেশদ্বারে নিখোঁজ জেলে বাবুল হোসেনের ঘর। ঘরে ঢুকতে হয়নি। বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন বাবুলের স্ত্রী মমতাজ বেগম আর তার ৩ মেয়ে। ওরাও নির্বাক। 

খানিক দূরে চর মনোহর ক্লোজারসংলগ্ন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে বাস করতেন নিখোঁজ জেলে আলী আজগর। মাত্র ৩ মাসের শিশু জান্নাতকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন আজগরের স্ত্রী শিলা বেগম। তার কান্নার শব্দে জেগে ওঠে শিশুটি। বিছানায় শুয়ে মায়ের সঙ্গে হাত-পা ছুঁড়ে সেও কাঁদে। ফলে কথা আর এগোয় না।

আজগরের বাবা মহিউদ্দিন জানালেন, ছেলের শোকে দু’সপ্তাহ ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু পেট তো মানে না ফলে তাকেও ফিরে যেতে হয়েছে ইলিশের নৌকায়। এখন আর তিনি সমুদ্রের নোনা জলে মাছ খোঁজেন না, ছেলেকে খোঁজেন- যদি একবার পাওয়া যায়।

সাত জেলে নিখোঁজের ঘটনায় এখন স্তব্ধ চর মনোহর জেলেপল্লী। গত বছর চরফ্যাশনের জিন্নাগড় ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর মাদ্রাজ গ্রামেও এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। নিখোঁজ এবং লাশ পেয়েছেন, এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তা জানা গেছে।

গত বছর ইলিশ মৌসুমে উত্তর মাদ্রাজ গ্রামে যে শোক নেমে এসেছিল তা এখনও মুছে যায়নি। নিখোঁজ হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, এরা কতটা অসহায়। এদের খোঁজ কেউ নেয় না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন তারা অসহায়। তবুও পরিবার পরিজন রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় জেলেরা। কারণ জীবিকা নির্বাহের এটাই একমাত্র পথ।

ভোলার চরফ্যাশনের উপকূলে প্রায় এক লাখেরও বেশি জেলে আছে। এদের অধিকাংশই ছোটবেলা থেকেই এ পেশায় যুক্ত। ফলে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোন পেশায় যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। 

এদিকে নদী, সমুদ্রে যেতে আগের চেয়ে ঝুঁকি বেড়েছে। নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ায় সাগরের আচরণ হটাৎ হটাৎ বদলে যাওয়ায় জেলে জীবনও আজ বিপর্যস্ত। ঝুঁকির এই পেশা যেন ক্রমেই অনিশ্চিত এক পেশায় পরিণত হচ্ছে। 

-এমএ

« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,