ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু দমনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কয়েকটি উদ্যোগের কথা প্রচার করা হলেও সে অনুযায়ী মাঠে কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
শীতের মৌসুম শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নগরীতে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনের তেমন কোন উদ্যোগ দেখছেন না নগরবাসী।
বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিসসহ সর্বত্রই মশার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নগরজীবন। মশার এই উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে তাড়া করছে গত ডেঙ্গু মৌসুমের ভয়।
তারা মনে করছেন, দুই সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তির উদ্যোগের সঙ্গে বাস্তবচিত্রের মিল নেই। বর্ষা মৌসুমের আগে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়ানক পর্যায়ে যেতে পারে।
গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। পরে এ রোগ অনেকটা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশে। কেবল সরকারি হিসেবেই মারা যান ১৬৬ জন। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। ডেঙ্গুর প্রকোপ চলে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। গত বছর এ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলেও এ বছর এখন পর্যন্ত মশক নিধনে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি দুই সিটি কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার দুই সিটিতে নবনির্বাচিত মেয়ররা শপথ নিলেও দায়িত্ব গ্রহণ করবেন মে মাসের শেষের দিকে। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন। তবে তিনি নিয়মিত অফিস করেন না বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, ঢাকা উত্তর সিটিতে নির্বাচিত মেয়র না থাকায় দায়িত্ব পালন করছেন ভারপ্রাপ্ত প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা। এর ফলে মশক নিধনে কোন উদ্যোগই গতি পাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মত মশক নিধনে ‘চিরুনি অভিযান’ চালাতে চেয়েছিলো ডিএনসিসি। সংস্থার উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় এক হাজার বিঘা জলাশয়, ডোবা, পুকুরের জলজ আগাছা ও কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছে। কাজ এখনো চলছে।
এছাড়া, ওয়ার্ড পর্যায়ে ১১টি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। সংস্থার ১০টি অঞ্চলে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক সভা করা হচ্ছে। তবে গত বছরের ডেঙ্গু মৌসুমে জরুরি ভিত্তিতে জার্মানির তৈরি ২০০ ফগার মেশিন ও পাঁচটি ভেহিক্যাল মাউন্টেন্ড ফগার মেশিন কেনা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেশিনগুলো সফল ভাবে ব্যবহার করতে পারেনি তারা।
অভিযোগ উঠেছে, মেশিনগুলো চালুর পর আগুন ধরে যায়। ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই তুলনামূলক বেশি দাম দিয়ে এগুলো কেনা হয়েছে।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. মোমিনুর রহমান বলেন, 'আমরা আমাদের রুটিন মাফিক কাজ করে যাচ্ছি। ডোর টু ডোর ভিজিটের কিছু কাজ করছি তবে এখনও ব্যাপক ভাবে শুরু হয়নি। কোন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রভাব বেশি এটা খুঁজে বের করতে একটা সার্ভে করার পরিকল্পনা রয়েছে। মানুষকে সচেতন করতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, টিভিসি প্রোগ্রাম করেছি।'
বর্ষার আগে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শুধু সিটি কর্পোরেশন একা কখনই মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আমাদের সকলকে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা, দায়িত্ববোধ থেকে নাগরকিদের কাজ করা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা এবং সিটি কর্পোরেশনের সক্ষমতাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যথায় মশা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হবে।'
মোমিনুর রহমান বলেন, 'করোনা ভাইরাসের কারণ আমাদের সকল পরিকল্পনাগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের কর্মীদের মাঝেও করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক রয়েছে।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, নিয়মিত প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধন কর্মীরা ঔষধ ছিটানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ তৈরি করার জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের আদলে রাজধানীতে কীভাবে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এতে।
কৌশলপত্রটির আলোকে একটি প্রকল্প গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ডিএসসিসি মনে করছে, কৌশলপত্র অনুযায়ী সরকার যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত সবধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
তবে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মত দক্ষিণ সিটিও আড়াই শতাধিক ফগার মেশিন আমদানি করেছে। প্রতিটি মেশিন এক লাখ ৬৭ হাজার টাকার দরে কেনা হলেও এগুলো এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে না। ভাণ্ডার বিভাগের সামনে কয়েকমাস ধরে এগুলো বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, 'মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের নিয়মিত কাজ চলছে। তবে আমরা সিঙ্গাপুরের আদলে ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ নামে যে বিভাগটি চালু করার কথা বলেছি, সেটার বিষয়ে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু সেখান থেকে এখনও কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতের মৌসুমের শেষ দিক থেকে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পেলেও নিয়মিত মশার ঔষুধ ছিটানো হচ্ছে না। কিছু এলাকায় ক্রাশ প্রোগ্রাম চললেও তা ঢিলেঢালা ভাবে চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তারা জানান, অনেক এলাকায় মশক নিধন কর্মীদের দেখাই যায় না।
খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, 'শীতের পর মশার উপদ্রব এতই বেড়েছে যে, ঘরে-বাইরে সব জায়গায় মশা কামড়াচ্ছে। কোথাও শান্তি নেই। দিন নেই, রাত নেই সব সময়ই মশার উৎপাত। সিটি কর্পোরেশন খুব বুলি আওড়াচ্ছে যে, তারা নাকি মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোন উদ্যোগই আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। আমাদের আশপাশের এলাকার কেউ বলতে পারবে না যে, তারা গত কিছুদিনের মধ্যে কোন মশক নিধনকর্মীকে ঔষুধ ছিটাতে দেখেছে। তাদের দেখাই পাওয়া যায় না।'
বাসাবো এলাকার বাসিন্দা ফিরোজা বেগম বলেন, 'মশার ভয়ে সব সময় ঘরের জানালা বন্ধ করে রাখি। তারপরও সন্ধ্যার পর মশার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকা যায় না। সিটি কর্পোরেশনের লোকদের তেমন দেখা যায় না। একবার ঔষধ ছিটাতে আসলে এক-দুই মাসে আর দেখা মেলে না।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় এডিস মশার পরিমাণ বেশি। এখন প্রধান কাজ হবে এসব স্থানকে গুরুত্ব দিয়ে পুরো রাজধানীতেই মশার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ওয়ার্ডভিত্তিক এডিস মশা নিধনে টিম গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিচ্ছন্ন সিটি গড়ার কার্যক্রমে যুক্ত করা।
-এমএ