অনুর্ধ্ব বিশ্বকাপ জয়ী বাংলাদেশ দলের অন্যতম বাহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম বুহস্পতিবার বিকালে গ্রামের বাড়ি দেবীগঞ্জের দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারী গ্রামে এসেছেন। এর আগে বিমানে করে ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে আসেন। সেখান থেকে বাবা মা ও এলাকার মানুষ তাঁতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। গ্রামের মৌমারী বাজারে পৌঁছালে এলাকাবাসী ব্যান্ডপার্টির বাদ্যসহ তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে এলাকার মানুষ ও শিক্ষকরা তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। অনেকে তাঁকে মিস্টি খাইয়ে বরণ করেন। যুব বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেই গ্রামের বাড়িতে উৎসবের আমেজ চলছে।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আনন্দ উচ্ছাস আর খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মৌমারী। দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ক্রিকেট ভক্তরা শরিফুলের বাড়িতে ভিড় করেছেন এবং দিনভর চলছে মিষ্টি খাওয়া আর আনন্দ উল্লাস। প্রথমবারের মতো বিশ^কাপ জেতার আনন্দটা উপভোগ করছেন অনেকেই।
শরিফুল জানান, বাবা-মা,আত্বীয় স্বজন ও এলকাবাসীর দোয়া ও ভালোবাসায় এতদূর এসেছি। ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলতে চাই। ভালো ক্রিকেট খেলে এলাকা ও দেশকে এগিয়ে নিতে চাই।
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রত্যয় হাসান, দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক চিশতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান হাসনাৎজ্জামান চৌধুরী জজ, আওয়ামীলীগ নেতা আবু বক্কর ছিদ্দিক, দন্ডপাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জামেদুল ইসলাম শরিফুলদের বাসায় গিয়ে শরিফুলের বাবা মা, পরিবারের সদস্যসহ এলাকাবাসিকে মিষ্টিমুখ করান এবং তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবর পেয়ে সোমবার সকাল থেকে লোকজন শরিফুলদের বাড়িতে ভিড় করছেন।
পঞ্চগড়ের এই বাঁ হাতি পেসার ম্যাচে একটি মেডেন ওভারসহ ৩১ রান খরচ করে দুটি উইকেট নিয়েছেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দুটি ক্যাচ নিয়েছেন, সরাসরি থ্রোতে একটি রানআউটও করেছেন। এই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই বাঁ হাতের নৈপুণ্য দেখিয়েছেন পঞ্চগড়ের সন্তান শরিফুল। দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন বিজয় চত্বরে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের খেলা দেখার ব্যবস্থা করেন। ক্রিকেট প্রেমি দর্শকরা এই খেলা উপভোগ করেন এবং বিজয় উল্লাস করেন। শরিফুল দেশে ফেরার পর আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান জানান, শরিফুলের বোলিং স্টাইল, নিখুঁত লাইন এবং লেন্থ দেখে আমরা অভিভূত। শরিফুল আমাদের দেবীগঞ্জের গর্ব। শরিফুল আমাদের অনর্ধ্ব ১৯ যুব বিশ্বকাপ নয়, সে জাতীয় টিমের পেস বোলার হিসেবে ভবিষ্যৎ কান্ডারি। ভবিষ্যতে শুধু যুব বিশ্বকাপ জয় নয়, জাতীয় টিমের গুরুত্বপূর্ণ বোলিংয়ের দায়িত্বে শরিফুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদি। আমরা আরও শরিফুল তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। সব ধরণের প্রশাসনিক সহযোগিতার জন্য আমরা শরিফুলের পরিবারের সঙ্গে আছি।
জানা গেছে, অমিত প্রতিভার অধিকারী পেসার শরিফুল ইসলামের পিতা দুলাল মিয়া একজন ক্ষুদ্র কৃষক মাতা বুলবুলি বেগম গৃহিনী। ৪ ভাইবোনের মধ্যে শরিফুল দ্বিতীয়। শরিফুল গ্রামের স্কুল কালিগঞ্জ সুকাতু প্রধান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হন।
শরিফুলের বাবা দুলাল মিয়া জানান, আর্থিক সংকটের কারণে এক সময় আমরা ঢাকার সাভারের জিরানী বাজারে চলে যাই। ওখানে রিক্সা চালাতাম। শরিফুল সাভারের জিরানীবাজার গোহালবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। পরবর্তীতে ২০১০ সালের দিকে আবারও গ্রামে চলে আসি। শরিফুল লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলতো। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠেঘাটে ক্রিকেট খেলতো। ক্রিকেটের প্রতি তার খুবই ঝোক ছিল। আজ সে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছে আমি খুবই খুশি।
তিনি জানান, বড় ছেলে আশরাফুল ইসলাম গ্রামে গরুর খামার দিয়েছেন। বর্তমানে সেখানেই কাজ করি। আমার বড় মেয়ে দুলালী আক্তার দেবীগঞ্জ মহিলা কলেজে এইচএসসি পড়ছেন। ছোট মেয়ে শম্পা আকতার কালিগঞ্জ এমপি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে।
শরিফুলের ছোট বোন দুলালী আক্তার জানান, আমার ক্রিকেট পাগল ভাই শরিফুল। লেখাপড়া যা করতো তার চেয়ে বেশি ক্রিকেট খেলে বেড়াত। ক্রিকেটের জন্য সারাদিন বাইরে ঘুরতো। একসময় সে দিনাজপুরের ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমীতে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে ক্রিকেটের কোচিং করতো। সেখান থেকে সে রাজশাহী যায়। সেখানে প্রথম ক্রিকেটে (লীগ) অংশ নেয়। পরে সে ঢাকায় যায়। সেখানে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে অভিষেক হয়।
শরিফুলের মা বুলবুলি বেগম জানান, আমাদের সাড়ে ১৯ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নেই। ছেলে আমার ক্রিকেট খেলে যা আয় করতো তার সবই অসহায় পরিবারের জন্য ব্যয় করতো। বিপিএলের সাড়ে ৫ লাখ আর শাইন পুকুরের সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি ও একটি খামার তৈরি করে দেন। এখন এই খামার দিয়েই আমাদের সংসার চলছে। শরিফুল দেশের জন্য যে সম্মান এনে দিয়েছেন তাতে বাবা মায়ের বুক ভরে গেছে। শরিফুলের বাবা মায়ের প্রত্যাশা ছেলে তাদের জাতীয় দলের হয়ে এভাবেই একদিন জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপের বিজয় এনে দেবে।
এসআইএস/এসআর