For English Version
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
হোম

ফেনীতে ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন

Published : Wednesday, 28 August, 2024 at 7:13 PM Count : 190



একনাগাড়ে বৃষ্টি ও ভারত হতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনী জেলায় প্রায় এক সাপ্তাহের বেশী সময় জুড়ে বন্যা চলমান। এতে জেলার সবকটি উপজেলায় প্রায় ১১ লাখ ৫০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল। তবে বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর জনজীবনে সমস্যা আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার মানুষ ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।  মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে৷ এই মুহূর্তে ফেনীতে খাদ্য, পানি ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে৷
ভেজা ও নষ্ট হওয়া আসবাবপত্রাদি, দুর্গন্ধময় পরিবেশ তছনছ। সাজানো গুছানো সংসার-এমন মানবিক বিপর্যয়ে এখন বেঁচে থাকাই দায়। এসব বিষয় জরুরীভাবে ব্যবস্থা না হলে এখানে মানবিক বিপর্যয় আরো গুরুতর হবে।

ফেনী জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বন্যায় দুই জনের মৃত্যু হলেও নিখোঁজ-মৃত্যু সংখ্যা আরও বেশি হবে। তবে এখন পর্যন্ত এসবের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় রোপা আমান, সবজি ক্ষেত, বিজতলা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছে। মানুষের বাড়ি-ঘরে চালা পর্যন্ত পানি উঠায় তাদের ঘরে থাকা আসবাবপত্র, কাথা- বালিশ, গৃহস্থালিসহ সকল প্রকার মালামাল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। 

বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ জানান, বন্যা শুরুর দিকে মাত্র ৩/৪ ঘন্টার ব্যবধানে প্রবল বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকে। মানুষজন তাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্র, ধান-চাল-ডাল, গৃহস্থলীর দ্রব্যাদী, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি রেখে কোনরকমে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে দৌড়ে বা কলা গাছের ভেলা বানিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু পানি নামার সাথে সাথে তাদের সেই ধ্বংসস্তূপে এসে দেখেন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পোষা বিড়াল বা কুকুরটিও আর নেই। তাদের সাজানো গোছানো ঘর-সংসার সবকিছুই বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

কোথাও কোথাও পানি কমলেও এখন আর সে কর্দমাক্ত ভেজা ঘরে বসবাস কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি মানুষের গোলায় রাখা ধান চাল ডাল পানিতে ভেসে গেছে। রান্নাঘরের চুলা, এমনকি লাড়কি কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

উপজেলাব্যাপী মাছের ঘের এবং পুকুরের মাছ সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। কোন কোন স্থানে কৃষকের গবাদি পশু কিছু কিছু রক্ষা করা গেলেও এখন গো-খাদ্যের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। উপজেলায় মুরগির খামার একটিও নেই। গরুর খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

উপজেলায়  গ্রামীণ সড়ক, শাখা পাকা রাস্তা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। মানুষের যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যার কারণে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিভিন্ন মানবিক সংগঠন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যেতে পারছে না। 

জেলা প্রশাসন জানায়, জরুরী স্বাস্থ্য সেবায় জেলার ১টি এবং ৬টি উপজেলায় ৬টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি ৬টি হাসপাতালে মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে। জেলা শহরে এসব বেসরকারি হাসপাতালসমূহ হল:  কনসেপ্ট হাসপাতাল, মেডিনোভা হাসপাতাল মেডিল্যাব, আল আকসা হাসপাতাল, জেড ইউ মডেল হাসপাতাল, মিশন হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

ইতোমধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা, ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌ-বাহিনী প্রধান এবং অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ সরেজমিনে ফেনীর বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং ত্রাণ বিতরণ করেছেন। 

তবে বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, ডুবুরি দল ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী টিম ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকায় ডিঙ্গি নৌকা ও স্পিডবোট, ভ্যান গাড়ি নিয়ে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে। পাশাপাশি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণেও সহায়তা করেন তারা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মানবিক সংস্থাসমূহ এখানে চিকিৎসা সেবা ও ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

সাত দিন বন্ধ থাকার পর জেলা হেডকোয়ার্টার এর সাথে ফেনী-পরশুরাম ও ফেনী-ছাগলনাইয়া এবং ফেনী-সোনাগাজী আঞ্চলিক সড়কে পরশুরাম, ফুলগাজী  ও ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলার যোগাযোগ কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। রাস্তার উপরের অংশ পানির তোড়ে ভেসে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। এতে সড়কগুলোতে ছোট যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে সড়কে যাত্রীবাহী যানবাহন না থাকায় দুর্ভোগে পোহাতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে। আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কে এখনো স্বাভাবিক হয়নি যান চলাচল। এতে জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তা উপেক্ষা করে ট্রাক-পিকআপে করে গন্তব্যে ছুটছেন মানুষজন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গ্যাস (সিএনজি) ও বিদ্যুৎ না থাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ রয়েছে।

জেলার কিছু কিছু এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো দুই-তৃতীয়াংশ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে এসব কিছুতে স্বাভাবিক গতি ফিরে পাচ্ছে।

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, র‍্যাব, বিজিবি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ছাত্র-জনতার চেষ্টায় উদ্ধার করা হয়েছে দেড় লাখ মানুষকে। এছাড়া বন্যা পরিস্থিতিতে নিজ উদ্যোগে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। 

ট্রাকে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরশুরাম থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব রহিম উল্লাহ। তিনি বলেন, রাস্তায় ট্রাক-ট্রলি ছাড়া আর কোনো যানবাহন নেই। জরুরি প্রয়োজনে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। ঝুঁকি থাকলেও বিকল্প নেই।

ফেনী সদর হাসপাতাল মোড় এলাকায় কামরুল ইসলাম নামে পিকআপে ওঠা একজন যাত্রী বলেন, বন্যার শুরু থেকে পরিবারের খোঁজ নেই। নিয়মিত পরিবহন না থাকায় ট্রাক-পিকআপই ভরসা এখন।

আবুল বাশার নামে এক ট্রাক চালক বলেন, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ, সড়কের অনেক স্থানে পানি থাকায় আমরা বড় গাড়িতে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে ৬২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌ, র‍্যাব হেলিকপ্টারের সহায়তায় আরও ৫৬ হাজার ৫০০ শত প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে। এর বাইরেও ব্যাপকভাবে বন্যা কবলিতদের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিয়েছে স্বচ্ছাসেবকরা।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত নগদ অর্থ সহায়তা ও চাউল ত্রাণকার্যের জন্য বরাদ্দ এসেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ী ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

ফেনীর আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কের ক্ষতি সম্পর্কে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) সূত্র জানায়, এখনো ক্ষতি নিরূপণ সম্ভব হয়নি। একইভাবে কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, প্রাণিসম্পদ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড জেলায় কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তারা বন্যার কারণে তা নিরূপণ করতে পারেনি বলে জানায়। বন্যার পানি নেমে গেলে তা নিরূপণ সম্ভব হবে বলে জানায়।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২ জুলাই টানা ৪/৫ দিনের অতি বর্ষণে অতি ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় প্রথম দফা ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি হয়। তখন উজানের পানির তোড়ে স্থানীয় মুহুরী কহুয়া সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে অন্তত ২০টি স্থানে ভেঙ্গে পানি ঢুকে বন্যার সৃষ্টি হয়। এক মাসের ব্যবধানে চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে টানা ভারী বৃষ্টিপাতে দ্বিতীয় দফা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে নতুন করে আরো ১০টি স্থানে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এতে পুনরায় উপরোক্ত উপজেলাসমূহ আবার বন্যায় কবলিত হয়। চলতি আগস্ট মাসের ২০ তারিখে তৃতীয় দফা ভয়াবহ বন্যায় কবলিত হয় ফেনীর সব উপজেলার মানুষজন।

এসআর


« PreviousNext »



সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
Editor : Iqbal Sobhan Chowdhury
Published by the Editor on behalf of the Observer Ltd. from Globe Printers, 24/A, New Eskaton Road, Ramna, Dhaka.
Editorial, News and Commercial Offices : Aziz Bhaban (2nd floor), 93, Motijheel C/A, Dhaka-1000. Phone : PABX- 0241053001-08; Online: 41053014; Advertisemnet: 41053012
E-mail: info$dailyobserverbd.com, mailobserverbd$gmail.com, news$dailyobserverbd.com, advertisement$dailyobserverbd.com,