তিস্তাপাড়ের বর্গাচাষী মফিজুলের সংগ্রামের গল্প
Published : Saturday, 10 February, 2024 at 4:46 PM Count : 199
তিস্তা নদীর তীর ঘেষা গ্রাম খোলাহাটির বর্গাচাষী মফিজুল। বয়স তাঁর ৩৬ বছর। নিজের জমিজমা না থাকায় কখনো রিক্সা চালিয়ে, কখনো বা গ্রামে গ্রামে ফেরি করে সংসার চলে তাঁর। তার ফাকে যেটুকু টাকা জমানো যায় তাই দিয়ে প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের কাছ থেকে সামান্য জমি বন্ধক নিয়ে চাষবাস করেন। এসব করে যতটুকু আয় রোজগার হয় তা দিয়েই ছয় সদস্যের পরিবারের ভরনপোষণ চালাতে হয়।
লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়ক ধরে জেলা শহর থেকে কিলোমিটার চারেক যাওয়ার পরেই মিলবে সাপ্টিবাড়ি-কালমাটি ইউনিয়ন সড়ক। সেই সড়কের আরও দুই কিলোমিটার এগোনোর পর রাস্তার একপাশে দেখা মেলে বেশ কিছু নীচু জমি।
স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় দোলা। সেই দোলা থেকে তিন চার'শ মিটার দূরেই তিস্তা নদী। জমিগুলোর কোনোটিতে তামাক, আলু কোনোটিতে সদ্য রোপণ করা হয়েছে বোরো ধানের চারা। চারপাশে কৃষকরা ব্যস্ত ফসলি জমির পরিচর্যায়। সেই 'দোলা'র কর্দমাক্ত এক খন্ড জমিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা মই ধরে টানছেন মাঝ বয়েসি মফিজুল। মেদহীন শরীরে পেশীগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। মফিজুলের মইটানাকে সহজ করতে কোদাল হাতে সহায়তা করছেন তাঁর সহধর্মিণী তানজু বেগম। আত্মীয়ের কাছ থেকে দেড়'শ টাকায় এক শতক জমি ভাড়া নিয়ে বোরো বীজ বুনেছিলেন। সেই চারা এনে বন্ধকি জমিতে রোপণ করতে চলছে কাঁদা করার কাজ।
মফিজুল জানান, দুই ভাই পাঁচ বোনের সবার ছোট সে। বাবা মোস্তাব আলী ছিলেন একজন প্রান্তিক কৃষক বা ক্ষুদ্র চাষী। বছর খানেক হলো তিনি মারা গেছেন। পিতার কাছ থেকে ভাগে পেয়েছেন সাত শতাংশ জমি। সেই সামান্য জমিতে ঘর তুলে বসবাস করেন। গত বছর জমানো এক লাখ দশ হাজার টাকা দিয়ে এক প্রতিবেশীর বিশ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়েছেন। আবাদ করার খরচ নিজের না থাকায় কিছু ধার আর বাকিতে সার কীটনাশক নিয়ে সেই জমিতে লাগিয়েছিলেন আমন ধান। যে ধান পেয়েছিলেন তার কিছু বিক্রি করে মহাজনের (সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী) বাকির টাকা শোধ করেছেন হালখাতায়। বাদবাকি রেখেছেন নিজের পরিবারের ছয়মাসের খাবার জন্য।
মফিজুল আরও জানান, তাঁর চার সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রহিমা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে জরিনা পঞ্চম শ্রেণিতে, সেজো মেয়ে মুন্নি মাদ্রাসায় আর সবশেষ ছোট মেয়ে মারিয়ার বয়স দুই বছর। মফিজুলের মা খাদিজা দুই ভাইয়ের সংসারেরই ভাগাভাগি করে থাকেন। টানাপোড়েনের সংসারে ছয় সদস্যের খাবার জুটলে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। সৌখিনতা বা বিলাসিতার ধারেকাছেও যেতে পারেন না তাই মফিজুল। তবে গত বছর ধানের আবাদ ভালো হওয়ায় এবারও ধান আবাদে মনোযোগী হয়েছেন। এবার তাঁর আশা গতবারের চেয়ে বেশি ফলন পাবার।তিনবছর আগে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে বন্ধক নিয়েছিলেন দশ শতাংশ জমি। এবার তার বন্ধক নেয়া জমি হয়েছে বিশ শতাংশ। আরও বাড়াতে চান জমি, তারপর কিনতে চান নিজের নামে জমি। তাই শ্রমিক না নিয়ে নিজারাই কষ্ট করছেন জমিতে। সকাল-বিকাল খেয়ে না খেয়ে লেগে আছেন আবাদে।
তাঁর সংগ্রামী জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প সম্পর্কে মফিজুল আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, "টাকার অভাবত আইজো একনা নিজের জমি হইল না। মাইনষের জমি দিয়া যেইকনা আয়উন্নতি হয় তাতে চলা নাগে। নিজের জমি থাকলে সংসার চালাইতে এত ব্যাগ (বেগ) নাগিল না হয়। নিজে খায়াপড়ি (খেয়েপড়ে) বেটিগুলাক মানুষ কইরবার পাইলে হইল।"
এমএস/এমবি