তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ও ঠান্ডায় বিপর্যস্ত ঠাকুরগাঁও জেলার জনজীবন। এতে ঠাকুরগাঁওয়ে চরম দুর্ভোগে দুঃস্থ, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন ছিন্নমূল মানুষ ও কর্মহীন শ্রমিকরা। তীব্র শীতে প্রশাসন, অনেক সামর্থবান ব্যক্তি বা সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
শনিবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
জানা যায়, টানা ৪/৫ দিন ধরে উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ঠান্ডা বাতাসে নাকাল হয়ে পড়েছে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারগুলো। গরম কাপড়ের অভাবে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তবে খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়েও ঠান্ডা নিবারণ হচ্ছে না। একদিকে অসহায়, দরিদ্র, দুঃস্থ ও ছিন্নমূল মানুষ তীব্র শীত, হিমেল হাওয়া ও ঠান্ডায় অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। আর অন্যদিকে কর্মজীবী শ্রমিকরা ঠান্ডায় কাজ করতে না পেরে না খেয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে পরিবার পরিজন নিয়ে।
এদিকে, কুয়াশা ও শীতে কৃষি ও কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কুয়াশা ও শীতে রাস্তায় গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। গাড়ি চালাতে গেলেও দিনের বেলায় হেড লাইড জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। আবার তীব্র শীত ও ঠান্ডায় অনেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি।
ঠাকুরগাঁওয়ে তাপমাত্রা নিরূপণের কোনো কার্যালয় নেই। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতিদিন তাপমাত্রা পরিমাপ করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, শনিবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সে সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৭-৯৮ শতাংশ। শুক্রবার সকাল ৭টায় জেলায় সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সে সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৪-৯৬ শতাংশ।
সদর উপজেলার বাসিন্দারা জানান, প্রতিবারই শুনি কম্বল দেওয়ার কথা। কিন্তু কম্বল পাইনা। মেম্বার-চেয়ারম্যান এলাও কম্বল দেয়না যে শীত আর কতদিন পরে কম্বল দেবে?
সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ হরি নারায়ণ রায় জানান, এমনিই এই এলাকায় শীত বেশি। আর এবার তো বৃষ্টি বা বর্ষা কম হইছে। এই জন্য অনেক শীত পড়ছে। শীতে সবার চেয়ে বেশি কষ্ট আমাদের মতো বয়স্কদের।
গাড়িচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, শীতের জন্য রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছে না। আর রাস্তায় মানুষের চলাফেরাও কমে গেছে। কুয়াশায় হেড লাইড জ্বালিয়ে গাড়ি চালাই । তারপরও দুর্ঘটনার ভয় থাকে। প্রচন্ড শীত ও কুয়াশায় আর গাড়ি কম চলায় রোজগার একেবারেই কমে গেছে। কিভাবে যে এই শীতে পরিবার নিয়ে চলবো?
সদর উপজেলার মুন্সিপাড়া মহল্লার দিনমজুর ও শ্রমিক রহমত আলী ও মহিবুল্লাহ জানান, শীত ও ঠান্ডায় হাত-পা শীতল হয়ে আসছে। কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। আর এই সময়ে মানুষ কোনো কাজও করাচ্ছে না, তাই অনেক শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। শীতে শ্রমিক ও দিনমজুরদের জন্য প্রশাসন ও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলে খুব উপকার হতো।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ডাঙ্গী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান ও খিরদ চন্দ্র বর্মন জানান, প্রচন্ড শীত, শৈত্যপ্রবাহ ও ঠান্ডার কারণে ফসলের অনেক ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে আলু, গমসহ বিভিন্ন শাক-সবজির ক্ষতি হচ্ছে। ঠান্ডায় মাঠে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা ও শরীর অবশ হয়ে আসছে। ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় কৃষি কাজ ও কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রকিবুল আলম জানান, কয়েক দিন ধরে ঠান্ডাজনিত রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিশু ও বৃদ্ধ। বিগত এক সপ্তাহে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে বরাদ্দ থাকার পরও শীতার্ত ও দুঃস্থ মানুষকে কম্বল দিতে পারিনি। কারণ এতে আচরণবিধি লংঘন হওয়ার বিষয় থাকে। তবে নির্বাচনের পরে কম্বল দেওয়া শুরু করেছি। এটা চলমান থাকবে।
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ'লীগের সভাপতি এ্যাড. অরুনাংশু দত্ত টিটো জানান, এই এলাকায় অসহায় দরিদ্র ও দুঃস্থ এবং ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই তীব্র শীতে তাদের কষ্ট লাঘব করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে কম্বল ও শীতবস্ত্র বিতরণ করছে। তবে এই দুর্যোগে বিত্তবানসহ সকলকে এগিয়ে আসা উচিত, মানুষের পাশে দাঁড়ানোও উচিত। আমরাও সাধ্যমত চেষ্টা করছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন জানান, উপজেলায় প্রাপ্ত বরাদ্দকৃত কম্বলগুলো ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সেগুলো বিতরণ হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় অনেক কম কম্বল আমরা পেয়েছি।
জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান জানান, উত্তরের এই জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতি বছরই এমনিতে অনেক শীত থাকে। তবে এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় শীত ও শৈত্যপ্রবাহ এবং ঠান্ডার মাত্রা অনেক বেশি। এই শীতে অসহায়, দুঃস্থ, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ যেন কষ্ট না পায় তার জন্য এক লাখ কম্বল চাওয়া হয়েছিল। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম পেয়েছি। আমরা আবারও চাহিদা দেব। এই তীব্র শীতকে মোকাবেলা করতে জেলা প্রশাসন সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।
-এএ/এমএ